সিমু নাসের
আমি যখন নার্সারিতে পড়ি তখন একটা কৌতুক শুনেছিলাম। ট্রাকচালক হাসপাতালে শুয়ে। পুলিশ অফিসার তাকে এসে বলল, ‘অ্যাকসিডেন্টটা কীভাবে হয়েছে?’ ট্রাকচালক করুণ মুখে বলল, ‘রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা লোক রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমি হর্ন দিলাম। লোকটা পড়িমড়ি করে রাস্তার পাশের জমিতে নেমে গেল। আমিও ট্রাক নিয়ে রাস্তা থেকে নেমে লোকটাকে ফলো করলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।’
এ রকম ফলো করলে কারোরই আসলে কিছু মনে থাকে না। গত সপ্তাহে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে মানুষ ট্রেনলাইনের ওপর বসে ফলো করছিল জনসভা, আর ট্রেন ফলো করছিল সেই রেললাইন।
ফলাফল-ট্রেনে কাটা পড়ে ছয়জনের মৃত্যু, ব্যাপক লুটপাট, যাত্রীদের দুর্ভোগ, ট্রেনে আগুন এবং ট্রেনচালক ও গার্ডদের গণপিটুনি।
এই ঘটনার এক দিন পর ট্রেনটির সহকারী চালক রাজগোবিন্দ বলেছেন, ‘আমি তো খুনি না যে ইচ্ছা করে কাউকে মেরে ফেলব। যে চালকের ট্রেনে কেউ মারা যায়, সেই চালকের কী যে খারাপ লাগে, তা শুধু সে-ই জানে। কিন্তু আমার কী দোষ। ওই সময় আমার কী-ই বা করার ছিল!’
বলেন কি রাজগোবিন্দ! কিছু করার ছিল না মানে? আপনার ও মূল চালকের অনেক কিছু করার ছিল। প্রথমত, আপনাদের উচিত ছিল ট্রেনটিকে লাইন থেকে বের করে নিয়ে জনসভা পাশ কাটিয়ে যাওয়া, তাদের রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সন্মান জানানো। খালেদা-অনুসারীদের সাইড দেওয়া। যেমনভাবে ব্রিজকে সাইড দিতে গিয়েছিলেন আমিনবাজারের বৈশাখী বাসের চালক।
এরও একটা পুরোনো কৌতুক আছে। হাসপাতালে শুয়ে পুলিশের জেরার মুখে ট্রাকচালক বলল, ‘গাড়ি চালাইতেছিলাম। পরথমে দেকলাম একটা মিনিবাস, সাইড দিলাম। পরে দেকলাম একটা বাস, হেইডারেও সাইড দিলাম। পরে একটা ব্রিজ দেখলাম, হেইডারেও সাইড দিলাম। পরে আর কিছু মনে নাই।’
প্রিয় রাজগোবিন্দ, একজন ট্রাকচালক পারলেন, বৈশাখী বাসের চালক হয়ে ব্রিজের মতো একটা বস্তুগত জিনিসকে সাইড দিতে পারলেন, আপনি একজন ট্রেনচালক হয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভাকে সাইড দিতে পারলেন না! খুবই খারাপ কথা। আপনাদের উচিত ছিল, জনসভাকে সাইড কাটিয়ে যাওয়া।
প্রিয় চালকদ্বয়, আপনাদের উচিত ছিল, জনসভার ঠিক আগমুহূর্তে ট্রেনটি নিয়ে আকাশে উড়াল দেওয়া। জনসভা পেরিয়ে আবার ট্রেনলাইনে নেমে আসা। এতে জনসভার লোকদের গায়ে ফুলের টোকাটাও লাগত না। আপনারা সেটা করেননি। আপনাদের তীব্র ধিক্কার!
প্রিয় চালকদ্বয়, আপনাদের উচিত ছিল, ট্রেন নিয়ে জায়গায় ব্রেক করে জায়গায় দাঁড়িয়ে যাওয়া। তাতে পেছনের আট-দশটা বগি হয়তো বা ছিটকে এদিক-সেদিক চলে গিয়ে যাত্রী আহত-নিহত হতো, কিন্তু জনসভার কেউ তো মরত না। বাস পারে, ট্রাক পারে, প্রাইভেটকার পারে, আর আপনারা কেন হার্ড ব্রেক করতে পারবেন না? আর যদি এটাকে হার্ড ব্রেক করে থামানোই না যায়, তাহলে এই জিনিস আপনারা চালান কেন? দেশ থেকেই ট্রেন নামক বাহনটাকে উঠিয়ে দেওয়া উচিত।প্রিয় চালকদ্বয়, আপনাদের উচিত ছিল, পূর্ববর্তী স্টেশনেই ট্রেনটির সামনে ফোম আর চাকায় টায়ার লাগিয়ে নেওয়া। এতে ইঞ্জিনের গায়ে মানুষ ধাক্কা খেলেও আহত হতো না। বরং ফোমের ধাক্কায় আরাম পেত। আর চাকায় টায়ার লাগালে ব্রেক করতেও আপনাদের সুবিধা হতো বলে আমাদের ধারণা। আপনারা তা না করে সরকারের এজেন্ট হিসেবে এমন কাজ করতে পারলেন?প্রিয় চালকদ্বয়, এ পর্যন্ত ট্রেনের কারণে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। এর প্রধান কারণ, ট্রেন ভূমি দিয়ে চলে। ট্রেন যদি কোনো রকম মাটির সংস্পর্শ ছাড়াই চলত, তাহলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না। আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, রোলার কোস্টারও এক প্রকার ট্রেন। কিন্তু সেটি মাটির ওপর দিয়ে না যাওয়ায় কাউকে এখন পর্যন্ত আহতও করেনি। ট্রেনটি কেন আপনারা রোলার কোস্টার স্টাইলে চালালেন না?
গত কয়েক দিনে অপঘাতে যতভাবে মানুষ মারা যাওয়া সম্ভব, ততভাবেই মারা গেছে। বাসে, পানিতে, আগুনে আর সর্বশেষ ট্রেনের নিচে পড়ে। এখন একটাই বাকি আছে, সেটা হলো বিমানে করে মারা যাওয়া। সেটাও সম্ভব। প্রিয় বিরোধী দল, হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে রানওয়ের একটা বিশাল জায়গা খালি আছে, সেখানে পরবর্তী জনসভাটা করে ফেলুন। এখানে আপনার দলীয় কর্মীর মৃত্যু হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাভারেজও পাওয়া যাবে। ধন্য আমাদের এই রাজনীতি।
কার্টুন : শিখা, ছবি : সাইফুল ইসলাম
ফুটনোট : ১১ অক্টোবর ২০১০ সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে রেললাইনের উপর বিএনপির জনসমাবেশ চলাকালে আন্তঃনগর দ্রুতযানের নীচে কাটা পড়ে ৬ জন মারা যায়। জনসভাটা হচ্ছিল রেললাইনের পাশ ঘেষে। পরে বিএনপির কর্মীরা ট্রেন থামিয়ে লুটপাট করে, দুই চালক ও গার্ডদের মারপিট করে ও ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে খালেদা জিয়া বলেন, এটি কোন দূর্ঘটনা নয়, এটি একটি এজেন্সির কাজ। বিস্তারিত জানতে ঘটনার পরের দিনের প্রথম আলোর প্রতিবেদন পড়ুন এখানে। আর এই লেখাটি রস+আলোতে প্রকাশিত হয় ১৮ অক্টোবর ২০১০।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন