আদনান মুকিত
আমাদের বাড়িটা একটু প্রাচীন টাইপের। বাড়ির সামনে উঠোনের মতো একটু জায়গা আছে। একপাশে বাবা বাগান করার চেষ্টা করেছেন। বাগানে ব্যাপক হারে মরিচগাছ লাগানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত গাছে একটা মরিচও হয়নি। তবে সেটা নিয়ে বাবাকে একটুও বিচলিত হতে দেখি না। তিনি চেয়ারে বসে নিজহাতে লাগানো মরিচহীন গাছের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমি নিশ্চিত, বাবা ব্যাংকার না হয়ে কবি হলে ‘ওই দেখা যায় মরিচগাছ’ টাইপের কবিতাও লিখে ফেলতেন। গাছের দিকে তাকিয়ে তিনি প্রায়ই বলেন, ‘গাছ থেকে মরিচ না পাই, অক্সিজেন তো পাচ্ছি। গাছের মূল জিনিসই হলো অক্সিজেন, কি বলিস?’ আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ি। বাবা বেশ
শান্তি পান। তিনি সব সময় শান্তিতেই থাকেন। শুধু মামা এলেই তাঁর শান্তি উধাও হয়ে যায়। এমনিতে মামার কোনো কাজ নেই, তবে বাবার
ধারণা, এ বাড়ির শান্তিশৃঙ্খলা ধ্বংস করাই তাঁর প্রধান কাজ। মামার মতো মানুষদের জন্যই নাকি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন, ‘প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইকোন, আমি ধ্বংস।’ মামাও মনে হয় তা-ই ভাবেন। কদিন হলো তিনি বাড়িতে এসেছেন এবং কিছুণ পরপর মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করছেন। যেমন, গত রাতে তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি কোনো দিন চাকরি করবেন না, শুধু ইন্টারভিউ দিয়ে যাবেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কেন? মামা বললেন, তাঁর নাকি চাকরি করার সময় নেই। ইন্টারভিউ দিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিতে চান, তিনি কী জিনিস। শুনেই বাবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মামা কোনো পাত্তা না দিয়ে তাঁর বক্তব্য অব্যাহত রাখলেন, ‘বুঝলেন দুলাভাই, অনেক প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দেব। কিন্তু কোনোটাতেই চাকরি করব না। মানুষ জিজ্ঞেস করবে, অবসর সময়ে আপনি কী করেন? আমি বুক ফুলিয়ে বলব, ইন্টারভিউ দিই। তারপর এক শুভ দিনে আমার সব ইন্টারভিউ কার্ড নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করব। এমন প্রদর্শনী মানুষ জীবনেও দেখেনি। ভেরি ইউনিক আইডিয়া।’
রাতের কথায় বাবার মেজাজ মনে হয় এখনো গরম আছে। উঠোনের চেয়ারে বসে কপাল কুঁচকে গেটের দিকে তাকিয়ে আছেন। লণ খারাপ। মেজাজ ভালো থাকলে বাবার দৃষ্টি থাকত মরিচগাছের দিকে। গেট পেরোলেই রাস্তা। হঠাৎ একটা রিকশা এসে থামল। রিকশা থেকে মামা নামলেন, হাতে ব্যাগ। মামা গেটের ও পাশ থেকেই বললেন, দুলাভাই, ভাংতি ১০ টাকা দিন তো, আমার কাছে সব বড় নোট।
বাবা রাগী ভঙ্গিতে ১০ টাকা দিতে উঠলেন। রিকশাভাড়া মিটিয়ে মামার হাতের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন,
- তোমার হাতে ওটা কী?
- থলে, দ্য ব্যাগ।
- থলের ভেতরে কী?
- বোমাটোমা নেই। চতুষ্পদ প্রাণীর মাংস। মানে গরুর মাংস। ভাবলাম, ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি, একটু ভালো কিছু খেয়ে যাওয়া উচিত। তাই নিয়ে এলাম, বেশ সস্তায় পেয়েছি।
- কী বললে? তুমি জানো না, গরুর মাংস খেলে অ্যানথ্রাক্স হবে? কোন সাহসে তুমি গরুর মাংস কিনেছ? আমার বাড়িতে এই অ্যানথ্রাক্স নিয়ে তুমি ঢুকতে পারবে না।
- সে কী? বাইরে দাঁড়িয়ে শালা-দুলাভাই ঝগড়া করছি, এটা ভালো দেখায় না, আমার প্রেস্টিজ না থাকতে পারে, আপনার তো আছে। ভেতরে এসে কথা বলি?
- আসতে হলে তোমার মাংস বাইরে রেখে আসো। নো গরুর মাংস ইন মাই হাউস।
- আমার মাংস নয়, দুলাভাই, এটা গরুর মাংস।
- ওই একই হলো। এ নিয়ে তর্কযুদ্ধ করতে চাইলে করতে পারো, তবে মাংস নিয়ে আমি ঢুকতে দেব না।
- ঠিক আছে। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্রমেদিনী। ওপেন দ্য ডোর।
মামা মাংসের ব্যাগটা বাইরে রাখতেই বাবা দরজা খুললেন। ভেতরে ঢুকেই মামা বললেন,
- দুলাভাই, আপনি অযথা ভয় পাচ্ছেন, জিনিসটা এত মারাÍক নয়। সব মিডিয়ার বাড়াবাড়ি।
- গাধার মতো কথা বোলো না!
- আট জেলায় মাত্র ৪৬টি গরু এ রোগে মারা গেছে। সংখ্যার তুলনায় খুবই কম।
- চুপ গাধা!
- এত গাধা গাধা করবেন না, শেষে অভ্যাস হয়ে যাবে। মানুষ জিজ্ঞেস করবে, ভাই আপনার নাম কী? আপনি বলবেন গাধা! কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে না?
- শোনো, সরকারি হিসাবে দেশে ছয় কোটি গরু-ছাগল-মোষ আছে। এর মধ্যে তোমাকে ধরা হয়েছে কি না বুঝতে পারছি না। ধরা না হলে ভুল হয়েছে। অবিলম্বে ধরা উচিত। সারা দেশের মানুষ গরু খাওয়া বাদ দিয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় রোগ ধরা পড়ছে, গরুর রক্ত খেয়ে অনেক শকুন মারা গেছে, আর তুমি বলছ মিডিয়ার বাড়াবাড়ি? মশকরা করো?
- আমাদের মন্ত্রীর কথাটা ভুলে গেছেন? আরে শকুন মরবে কীভাবে? দেশে তো শকুনই নেই। আর রোগটা ধরা পড়েছে সিরাজগঞ্জে। সেখান থেকে গরু ঢাকায় আসবে কীভাবে? মাইকেল ফেলপস হলে না হয় সাঁতরে চলে আসত। গরু তো ফেলপস না।
- কিন্তু মানুষ তো আক্রান্ত হচ্ছে। তা ছাড়া গরুও মারা যাচ্ছে। তার কী হবে?
- ওহ দুলাভাই, ১৮ তারিখের পর আর কোনো গরু মারা যায়নি। তা ছাড়া নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাওয়া যায়নি। এটা আমার কথা না, স্বয়ং মন্ত্রীর কথা। আমি ফাজলামো করতে পারি, মন্ত্রী সাহেব নিশ্চয়ই ফাজলামো করবেন না।
- হুমম, তাহলে উপায়?
- খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই, দুলাভাই। আপনি অনুমতি দিলে মাংসটা ভেতরে আনতে পারি। অনেক দিন গরুর মাংস খাই না।
- বাবা কিছুই বলছেন দেখে মামা বললেন, নীরবতা সম্মতির লণ। এই, তুই বসে বসে কী করছিস? যা, মাংসের ব্যাগটা ভেতরে নিয়ে আয়।
আমি এক দৌড়ে গেটের কাছে গিয়ে দেখি কোনো ব্যাগই নেই। এদিক-ওদিক খুঁজেও কিছু পেলাম না। মামা এসে বললেন, অলস বালক, এক কেজি মাংস আনতে এতণ লাগে? চড় দিয়ে তোর মাড়ির মাংস ফুলিয়ে ফেলব।
- মামা, কিছুই তো নেই।
মামা হায় হায় করে উঠলেন। অনেক দূর থেকে ময়লাওয়ালার বাঁশির শব্দ শোনা গেল। মামা মাথায় হাত দিয়ে বসে বললেন, কিছুই বুঝলাম না, মাংস নিল কে?
মাংসের ব্যাগটাকে ময়লার ব্যাগ ভেবে ময়লাওয়ালা যে সেটা গাড়িতে ফেলে দিয়েছে, তা মামা না বুঝলেও আমি ভালোই বুঝেছি। যাক, মামার কথায় ঝুঁকি নিয়ে আর গো-মাংস খেতে হচ্ছে না। এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।
কার্টুন : রকিবুল হাসান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন