মাহফুজ রহমান, ওয়েবসাইট অবলম্বনে
নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হলে লোকে কত কিছুই না করে। বিশেষ করে মাথা ঘামানো তো মামুলি ব্যাপার। কিন্তু ইগ নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হলে আপনাকে ঘামতে নিষেধ করা হয়েছে। অবশ্য ঘামাঘামির কোনো প্রশ্নই আসে না। আগে হাসুন, তারপর ভাবুন- এমন একটা স্লোগানের কথাই বলে ইগ নোবেল কমিটি। কেন বলে, এর বিচার-বিশ্লেষণ পরেই করুন। তার আগে জেনে নেওয়া ভালো, ইগ নোবেল পুরস্কারটির পেছনে হাস্যরসের উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও, তা মোটেও খেলো ব্যাপার নয়।
ইগ নোবেলের লোগোতে খ্যাতনামা শিল্পী অগাস্তে রদিনের ‘দ্য থিংকার’ - এর প্রপাত ধরণীতল অবস্থা দেখে আগে হাসুন, পরে ভাবুন |
ইগ নোবেল পুরস্কারের ধারণাটি মূলত আলফ্রেড নোবেলের প্রণীত পুরস্কারটি থেকেই এসেছে। একে আপনি নোবেলের প্যারোডিই বলতে পারেন। আর তা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানালস অব ইমপ্রোবাবল রিসার্চ নামের বিজ্ঞানভিত্তিক একটি ম্যাগাজিন। প্রতিবছর অক্টোবর মাসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ অবদানের জন্য দেওয়া হয় এই পুরস্কার। বিশেষ অবদান বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে সেসব বিষয়কে, যেসব বিষয় এমনিতে খুব সাধারণ মনে হতে পারে; কিন্তু
বেশ কেজো। পাশাপাশি এ থেকে যেন সাধারণ মানুষ প্রাণ খুলে হাসতে পারে।
ইগ নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য জমকালো এক আসর বসে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যান্ডারস থিয়েটারে। সেখানে উপস্থিত থাকেন সত্যিকারের নোবেলজয়ীসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। প্রথম ইগ নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ১৯৯১ সালে। এর পর থেকে নোবেলের মতোই পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, জীববিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব অবদানের জন্য নিয়মিতভাবে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এবার ইগনোবেলের ২০ বছর পূর্তি ছিল। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালের ইগ নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, পুরস্কারটির পেছনে থাকে যথেষ্ট কৌতুক-হাস্যরস। তার প্রমাণ দেখুন এবারের ইগ নোবেলজয়ীদের কাণ্ডকীর্তির ফিরিস্তিতে।
চিকিৎসা
চিকিৎসকের পেছনে ছুটে ছুটে যাদের জান খারাপ অবস্থা, তাদের জন্য এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে এক ঢিলে দুই পাখি মারার অভাবনীয় সুযোগও বটে। রোলার কোস্টারে চড়লে হাঁপানির লণগুলো টের পাওয়া যায়Ñএমন এক তত্ত্বই আবিষ্কার করে চিকিৎসাক্ষেত্রে এবার ইগ নোবেল বাগিয়েছেন দুই বিজ্ঞানী। তাই দেরি না করে হাঁপানির পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ না হয়ে সোজা গিয়ে রোলার কোস্টারে চাপুন।
পদার্থ বিজ্ঞান
এ বছর পদার্থে ইগ নোবেলজয়ীরা পাদুকা বা জুতা নামের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুটির কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। তবে এত দিন জুতার ভেতর বেশ আরামে দিন কাটানো মোজাসমাজের কাছে ব্যাপারটি উল্টো। এতে করে হয়তো পদার্থে ইগ নোবেলজয়ীদের ওপর পপাতদুষ্টতার অভিযোগও তুলতে পারে তারা। মোজার ব্যবসায়ীরা অবশ্য আনন্দে বিগলিতই হবেন। কারণ, তিন ইগ নোবেলজয়ী পদার্থবিদ গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন, শীতকালে বরফে ঢাকা ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় জুতার ওপরে মোজা পরে নিলে পিছলে পড়ার ঝুঁকি থাকে না। তাই মোজার ওপর জুতা নয়, জুতার ওপর মোজা।
প্রকৌশল
‘ব্যাঙের সর্দি’ বলে একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু তাই বলে তিমির সর্দি! হ্যাঁ, এই তিমির সর্দি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা তিনজনের হাতেই এবার প্রকৌশলে ইগ নোবেল পুরস্কারটি উঠেছে। রিমোট-নিয়ন্ত্রিত হেলিকপ্টার ব্যবহার করে তিমির সর্দি আহরণের একটা জটিল পথ বাতলে দিয়েছেন তাঁরা। তবে তিমির সর্দি মনুষ্যকুলের কোন উপকারে আসবে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
‘ডিম আগে না মুরগি’ বির্তক থেকেই কি এ ক্রেস্টের ভা |
দূরে গিয়ে মর বা তোর পেটে পিলে হবে- এমন অভিশাপবাক্য শুনে এখন থেকে ব্যাজার হবেন না। বরং আরও বেশি বেশি করে অভিশাপবাক্য শুনুন এবং অন্যের ওপর প্রয়োগ করুন। না না, আগেই তেড়ে আসবেন না। এই কথাগুলো এ বছর শান্তিতে ইগ নোবেলজয়ীদের। তাঁদের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, অভিশাপ বেদনানাশক। অন্য কাউকে অভিশাপ দিলে মনে শান্তি ভর করে। দুঃখ-কষ্ট যায় মুছে। তাই শান্তির জন্য যুদ্ধ নয়, নিয়মিত অভিশাপ বর্ষণে ব্যস্ত থাকুন।
ব্যবস্থাপনা
ব্যবস্থাপনায় এবারের ইগ নোবেলজয়ীদের কথা শুনলে আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো হায় হায় করে উঠবে। ইতালির ইউনিভার্সিটি অব কাতানিয়ার তিন দুঁদে অধ্যাপককে পাগলের খাতায়ও ফেলে দিতে পারে। অনেক দিন ধরেই ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একসঙ্গে মাথা ঘামিয়েছেন সেই অধ্যাপকেরা। মাথা ঘামিয়ে তাঁরা একটি সূত্র আবিষ্কার করেছেন শেষমেশ। সূত্রটির সারসংপে হলো- একটি প্রতিষ্ঠান আরও কার্যকর হতে পারে, প্রতিষ্ঠানটি যদি সাধারণ জনগণের সঙ্গে নিজেদের আরও ভালোভাবে যুক্ত করতে পারে। আরও সোজা করে বললে, সাধারণ জনগণকে প্রতিষ্ঠানের সব রকম কর্মকাণ্ডে আপন করে নিতে পারলেই সাফল্য নিশ্চিত!
জীববিজ্ঞান
প্রাণী মাত্রেরই আছে যৌনজীবন, কে না জানে এটা? কিন্তু এর ভেতরেও যে অনেক জটিল প্রক্রিয়া আছে, তা কে জানত বলুন! জীববিজ্ঞানে এ বছর ইগ নোবেলজয়ী আট বিজ্ঞানী তা-ই জানিয়েছেন। তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন, ফলখেকো এক ধরনের বাদুড়ের যৌনজীবন বেশ অদ্ভুত। ওই প্রজাতির মেয়ে বাদুড়গুলো আজব আজব সব কাণ্ডকীর্তিতে বেশ পটু। বিশেষ করে ছেলেবাদুড়দের সঙ্গে এমন সব কাণ্ড তারা করে, যা শুনলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়।
যোগাযোগব্যবস্থা
যোগাযোগব্যবস্থার ওপর এবার ইগ নোবেলজয়ীদের তালিকা দিয়ে ছোটখাটো একটা রেললাইনই হতে পারে। কারণ, সেই তালিকায় আছে মোট নয়জনের নাম। কী করেছেন তাঁরা? লম্বা এই তালিকাভুক্তরা লম্বা এক বিষয় নিয়েই মাথা ঘামিয়েছেন। মানবশরীরের ভেতর দিয়ে হাজারো শিরা-উপশিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই শিরা-উপশিরাগুলো দারুণ সুবিন্যস্ত। একটার সঙ্গে আরেকটার সামান্যতম ঠোকাঠুকিও হয় না কখনো। আর মানবশরীরের এই শিরা-উপশিরাগুলোকে মডেল হিসেবে ধরে রেলপথের নকশা প্রণয়ন করেছেন এবারের ইগ নোবেলজয়ীরা। এই নকশা অনুসারে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগ সম্ভব- এটাও তাঁরা প্রমাণ করেছেন।
অর্থনীতি
এবার অর্থনীতিতে ইগ নোবেল উঠেছে বিশ্বের বড় বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ও পরিচালক গোছের কয়েকজনের হাতে। নতুন নতুন পথে ও উপায়ে টাকাপয়সা বিনিয়োগের অভিনব কিছু পথ বাতলে দিয়েছেন বলেই এই পুরস্কার জুটেছে তাঁদের আখেরে। ইগ নোবেল কমিটির মতে, বিশ্ব অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ এবং ঝুঁকি কমানোর অনেক পথই সাধারণ জনগণকে দেখিয়ে দিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তারা।
গণস্বাস্থ্য
শ্মশ্র“মণ্ডিত দাদা-নানারা হয়তো এবার তেড়েই যাবেন তাঁদের মুণ্ডুপাত করতে। কাদের মুণ্ডুপাত? গণস্বাস্থ্যে এবার ইগ নোবেল জিতেছেন যাঁরা, তাঁদের? কারণ তাঁরা পরীক্ষা চালিয়ে প্রমাণ করেছেন, গবেষণাগারে কিংবা প্রতিদিনকার জীবনে শ্মশ্র“মণ্ডিতেরা বেশি পরিমাণে জীবাণু বহন করে এবং এদের কারণেই অনেক রোগ-জীবাণুর বিস্তার ঘটে আমাদের চারপাশে, বিশেষ করে গবেষণাগারের মতো স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে।
রসায়ন
বাংলা সিনেমায় নায়িকার বাবাদের মুখে হরহামেশাই একটি বাক্য শোনা যায়- শোনো ছেলে, তেলে জ্বলে কখনো মিশ খায় না...! এবার বোধহয় এই চিরন্তন বাক্যটির যবনিকাপাত হতে চলেছে। আর তা করছেন এ বছর রসায়নে ইগ নোবেলজয়ী তিনজন। দীর্ঘ দশ বছরের গবেষণা শেষে এঁরা দেখিয়েছেন, সমুদ্রের গভীরে খনিজ তেল এবং গ্যাসের মিশেলে এক ধরনের তেল উৎপন্ন করা যায়, যা কিনা সমুদ্রের পানিতে মিলেমিশে একাকার হতে পারে। বাংলা সিনেমার হতদরিদ্র নায়কেরা এবার হয়তো বলে উঠবেন- অমুক সাহেব, মনে রাখবেন, তেলে জলে এখন মিশ খায়!
আঁন্দ্রে গেইমের সাক্ষাৎকার
আঁন্দ্রে গেইম। ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের এই পদার্থবিদ ২০০০ সালে চুম্বক ব্যবহার করে একটি জীবন্ত ব্যাঙকে শূন্যে ভাসিয়ে রেখে ইগ নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। সেই আঁন্দ্রে গেইম পদার্থে ২০১০ সালে সত্যিকারের নোবেলও জিতে নিয়েছেন। তিনিই একমাত্র এবং প্রথম এই কৃতিত্বের অধিকারী। কয়েক দিন আগে নোবেল পুরস্কার কমিটির প্রধান সম্পাদক অ্যাডাম স্মিথকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। নিচে ওই সাাৎকারের শেষাংশটি (এবং সেটির ইগ নোবেলীয় সংস্করণ) পড়ুন :
অ্যাডাম স্মিথ : ধন্যবাদ। সাক্ষাৎকারটি শেষ করতে চাইছি একটি প্রশ্ন দিয়ে। আর তা হলো, আমার জানা মতে, আপনিই একমাত্র কীর্তিমান, যিনি একাধারে ইগ নোবেল এবং নোবেল- এই দুটি পুরস্কারই জিতেছেন। আপনার কি কোনো পরিকল্পনা...
আঁন্দ্রে গেইম : আমার জানা মতেও ঠিক তা-ই, আমিই একমাত্র দুই নোবেলজয়ী!
অ্যাডাম স্মিথ : তো, ওই পুরস্কার দুটি আপনার অফিসে সাজিয়ে রাখার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
আঁন্দ্রে গেইম : আহ্, ইগ নোবেল পুরস্কার...হ্যাঁ, আমার অফিসে ইগ নোবেল পুরস্কারটি আছে। তা দেখতে সুন্দরও বটে। বিশেষভাবে বলছি, আমি ইগ নোবেল পুরস্কারের জন্য গর্বিত। তবে শুধু ইগ নোবেল একটি পুরস্কার বলে নয়, এই পুরস্কারটি দেওয়া হয় একটা সূক্ষ্ম কৌতুক এবং রসবোধসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এই পুরস্কার মানুষকে প্রাণ খুলে হাসাতে পারে। এবং আমার আবিষ্কারের পেছনে সেটাই ছিল বড় উদ্দেশ্য বা টোটকা। আর নোবেল পুরস্কারের বেলায় যা বলব, তা হলো, এটা অবশ্যই যে, তুমি যদি আমাকে প্রস্তাব দাও, আমি নোবেল পুরস্কার ফেলে দিতে মোটেও কুণ্ঠিত হব না।
২০০০ সালের ইগ নোবেল গ্রহণ করছেন আঁন্দ্রে গেইম |
আঁন্দ্রে গেইম : তবে ইগ নোবেল দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, পুরস্কারটি নেব কি না। তখন তা বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল। ইগ নোবেল নেব কি না! বলা বাহুল্য, শেষতক তা নিয়েছিলাম। তাই বলতে পারি, ইগ নোবেলকে হেলাফেলার চোখে না দেখে এবং তা গ্রহণ করে আমি ধন্য।
অ্যাডাম স্মিথ : দেখে-শুনে যা মনে হচ্ছে, ইগ নোবেল নেওয়া আপনার জন্য তিকর কিছু হয়নি শেষমেশ, অন্তত হিতে বিপরীত তো হয়ইনি।
আঁন্দ্রে গেইম : হ্যাঁ, অবশ্যই। আর ইগ নোবেলের কারণেই তো আমার অজানা অধ্যায় সবার সামনে খোলাসা হলো।
অ্যাডাম স্মিথ : হ্যাঁ, তা তো বটেই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে...
আঁন্দ্রে গেইম : তোমাকেও ধন্যবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন