পরিমল গোস্বামী
একটি ইংরেজি গল্প পড়িয়াছিলাম। গল্পটি এইরূপ : জীবনে নানারূপ অ্যাডভেঞ্চার করিয়াছেন বলিয়া জনৈক ভদ্রলোকের বড়ই গর্ব ছিল। ১০-১২টি মাত্র অ্যাডভেঞ্চারের গল্প ছিল তাঁহার সম্বল। তিনি ইহারই কোনো না কোনো একটার দ্বারা সর্বত্র মজলিশ জমাইতেন। সিংহ-শিকার হইতে প্রেম করা এবং সিংহ-শিকার হইতে প্রেম করার মধ্যবর্তী কয়েকটি পর্যায় ছিল তাঁহার অ্যাডভেঞ্চারের বিষয়। একদিন তিনি তাঁহার এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েকজন নবাগত ব্যক্তিকে লইয়া আসর জমাইয়া বসিয়াছেন। বিস্ময়-বিমুগ্ধ শ্রোতাদিগকে তিনি বলিয়া যাইতেছেন, ‘মনে করুন, একা আমি সেই গভীর জঙ্গলে, হাতে একটা মাত্র বন্দুক। আফ্রিকার জঙ্গল। কিছুণ অনুসন্ধানের পরেই আমার প্রার্থিতের দেখা পেলাম। প্রকাণ্ড সিংহ! সঙ্গে সঙ্গে গুলি। গুলি খেয়ে সিংহটা ঘোর গর্জন করে লাফিয়ে পড়ল আমার ঘাড়ে...।’
গল্পটি এই পর্যন্ত বলা হইয়াছে, এমন সময় ভৃত্য আসিয়া সংবাদ দিল, তাঁহাকে তাঁহার বাড়ি হইতে টেলিফোনে ডাকিতেছে। ভদ্রলোক চট করিয়া উঠিয়া গেলেন। শ্রোতারা আকুল আগ্রহে তাঁহার প্রত্যাগমনের অপো করিতে লাগিল।
মিনিট তিনেক পরে ভদ্রলোক ফিরিয়া আসিলেন। ফিরিয়া আসামাত্র সকলে ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করিল, ‘তার পর কী হলো?’ কিন্তু ভদ্রলোক কোন গল্পটি করিতেছিলেন, তাহা ইতিমধ্যে ভুলিয়া গিয়া প্রশ্নের উত্তরে বলিলেন, ‘তারপর তাকে চুম্বন করলাম এবং বিদায় নিয়ে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরে এলাম।’
২
দেশি গল্পটি গল্প নহে, একটি মর্মান্তিক সত্য ঘটনা। বাঙালি মেয়েরা এত সেন্টিমেন্টালও হইতে পারে! থিয়েটার-বায়োস্কোপ তাঁহাদের না দেখাই ভালো, বিশেষ করিয়া ছাত্রীদের। পরীক্ষা আসন্ন জানিয়াও তাঁহারা সপ্তাহে অন্তত একবার সিনেমা দেখিবেন এবং মাসে দুইবার থিয়েটার! কোনো দিক দিয়েই নিজের মনের ওপর নিজের কোনো প্রভাব নাই- মনটা টেলিগ্রাফ যন্ত্রের শব্দের মতো দিবারাত্র টক্কা টক্কা করিতেছে।
এমন ছাত্রীর কথাও জানি, যিনি পরীক্ষার তিন দিন আগেও সিনেমার কোনো একটি বিশেষ ছবি দেখিয়া সর্বসাকল্যে বিংশতিতম সংখ্যা-পূরণের গর্বে আÍহারা হইয়াছেন।
মিস্ ব্যানার্জি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিস্টোরি পড়েন। ফিফথ-ইয়ার। তাঁহার লেখা একটি হিস্টোরির প্রশ্নের উত্তর আমি দেখিয়াছি। দৈবক্রমে দেখিয়াছি। দেখা অন্যায় জানিয়াও দেখিয়াছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমার চেয়েও, যিনি দেখাইয়াছেন তাঁহার অন্যায় বেশি। মিস্ ব্যানার্জি নাট্যমন্দিরে বিজয়া এবং চন্দ্রগুপ্ত নাটক যে একাধিকবার দেখিয়াছেন, তাহা তাঁহার এই লেখাতেই প্রকাশ পাইবে। প্রফেসরের দেওয়া প্রশ্ন এবং মিস্ ব্যানার্জির দেওয়া উত্তর দুটিই দিলাম। বলা বাহুল্য, দুইটিই ইংরেজি হইতে অনুবাদ এবং ইহাতে যদি কোনো ভুল থাকে, সে জন্য আমি দায়ী নহি।
প্রশ্ন : ভারতবর্ষের ইতিহাসে চন্দ্রগুপ্তের স্থান কোথায়?
উত্তর : ‘ভারতবর্ষ’- এই একটিমাত্র নামের দ্বারা এত বড় দেশকে এক কল্পনা করিয়াছিলেন কবি ও রাষ্ট্রনীতিকগণ। এই কল্পনা আংশিকভাবে প্রথম কার্যে পরিণত করেন চন্দ্রগুপ্ত। তাঁহার রাজত্বকালে আমরা শাসনের যে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর পদ্ধতি দেখিতে পাই, তাহার পরিপূর্ণতা হঠাৎ একটিমাত্র সম্রাটের হাতেই কিরূপে সাধিত হইল, ইহা অনুসন্ধিৎসুর নিকট বিস্ময়কর হইলেও তাঁহার পূর্ববর্তী কালের সঠিক বিবরণ, তথ্য বা ইতিহাস না পাওয়াতে ধরিয়া লইতে হইবে যে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তই নিজের অসাধারণ মতা এবং প্রতিভাবলে একটি সম্পূর্ণ অভিনব শাসনপদ্ধতি এবং পূর্ণাঙ্গ বিধিব্যবস্থার উদ্ভাবন করিতে সম হইয়াছিলেন। কুরুেেত্রর যুদ্ধকাল পর্যন্ত (ব্রাত্য রাজাদিগের কথা ছাড়িয়া দিলে) আমরা আর্য রাজাদিগকেই দেখি এবং চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের পূর্ব পর্যন্ত অন্য কোনো বড় অনার্য রাজাকে দেখি না। সুতরাং যত দূর জানিতে পারা যায়, চন্দ্রগুপ্তই ভারতবর্ষের সত্যকার প্রথম অনার্য সম্রাট। কিন্তু এতৎসম্পর্কে একটি কথা বলা আবশ্যক। রাজা যিনিই হউন, রাজ্য পরিচালনা-কার্যে মন্ত্রণাদান চিরকাল ব্রাহ্মণেই করিয়াছেন। চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রণাদাতা ছিলেন ব্রাহ্মণ চাণক্য। চন্দ্রগুপ্ত এই চাণক্যের হাতে গড়া রাজা। গ্রিকদের হইতে দেশের সম্মান এবং স্বাধীনতা রাকার্যে প্রতিভাবান যুবক চন্দ্রগুপ্তকে ব্রাহ্মণ চাণক্য কিরূপ সফলতার সহিত ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহাও আমরা চন্দ্রগুপ্তের সময়ে প্রত্য দেখিতে পাইতেছি।
অর্থশাস্ত্র-এর বিষয়বস্তু দেখিয়া যদিও ইহা প্রমাণ হয় না যে একমাত্র চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বেই সমাজনীতি এবং রাজনীতির চরম উন্নতি হইয়াছিল, কারণ চন্দ্রগুপ্তের সময়ের পূর্ব হইতে ইহার অস্তিত্ব না থাকিলে ‘বৃন্তহীন পুষ্পসম’ হঠাৎ ইহার পূর্ণ বিকাশ হইতে পারে না, তথাপি এ কথাও স্বীকার্য যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে রচিত এইরূপ ঐতিহ্য থাকায় ইহা বেশ বোঝা যায় যে রাজনীতি ইত্যাদি পূর্ব হইতেই থাকিলে, হয় ঐ শাস্ত্রগুলি চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে উন্নতি লাভ করিবার সুযোগ পাইয়াছিল, কারণ বড় রাজত্বের জন্যই ব্যাপকতর রাজনীতিরও প্রয়োজন অনুভূত হইয়াছিল। অথবা যদি ইহা পরবর্তীকালে রচিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক বলিয়া প্রচারিত হওয়ায় ইহাই প্রমাণ হয় যে চন্দ্রগুপ্ত বড় রাজা ছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মোটের ওপর ভালোই লাগিল। শ্রীযুক্ত শিশিরকুমার ভাদুড়ী চাণক্যের ভূমিকায় যেরূপ দতা দেখাইয়াছেন তাঁহার সহকর্মীগণ সেরূপ পারেন নাই, বিশেষত চন্দ্রগুপ্তের ভূমিকায় যিনি নামিয়াছিলেন, তিনি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ চন্দ্রগুপ্তকে অত্যন্ত খাটো করিয়া ফেলিয়াছেন। চাণক্যেরই আর একটি রূপ দেখিলাম আমরা রাসবিহারীর চরিত্রে। কঙ্কাবতী বিজয়ার ভূমিকায় অদ্ভুত অভিনয় করিয়াছেন। তাঁহার হাবভাব, চালচলন, কথা বলার ভঙ্গি, সমস্তই অত্যন্ত সুমার্জিত। বিজয়ায় ইহাকেই দেখিব বলিয়া পুনরায় গিয়াছিলাম, কিন্তু নিরাশ হইয়াছি। নরেনের ভূমিকাতেও অন্য লোক- বিশ্বনাথ ভাদুড়ী নাই। কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরিয়া আসিলাম। দিদি, তুমি আসিলে আর একবার দেখিবার ইচ্ছা রহিল, কিন্তু কে কোন ভূমিকায় নামিবেন পূর্বে ঠিক ঠিক না জানিয়া কিছুতেই যাইব না। মনের মতো না হইলে সিনেমায় যাইব। আশা করি, খোকা-খুকিরা ভালো আছে।
পরিমল গোস্বামী : ভারতীয় লেখক।
কার্টুন : রকিবুল হাসান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন