মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্যারডি লিখেছেন সিমু নাসের পূর্বকথা
২১৫০ সালের জানুয়ারি মাসের সুন্দর এক সকাল। লাইনা তার নিও পলিমারের পোশাকটুকু শরীরে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বাই ভার্বালে করে ১১৭ তলার ফ্যাট থেকে নিচের ল্যান্ডিংয়ে নেমে আসার সময় শুনতে পেল বাসার সাহায্যকারী তৃতীয় প্রজাতির রোবট রু-এর একঘেয়ে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, ‘লাইনা, বাইরের তাপমাত্রা এখন ১৫০ সে. কিন্তু তোমার নিও পলিমারের ১৭০ সে. তাপমাত্রা প্রতিরোধ করার মতা আছে। আমার মনে হয় তোমার আরেকটু বেশি মাত্রার নিও পলিমার পরে বাইরে বের হওয়া উচিত। এই ২০ সে. তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে তোমার শরীরে যেসব অসুবিধা দেখা দিতে পারে তা হলো...।’ পুরোটুকু শোনার আর সময় হয়নি লাইনার, তার হাতে একফোঁটা সময় নেই। নিচে তার জন্য রুহান অপো করার কথা।
বাই ভার্বাল থেকে নামতে নামতে লাইনা দেখতে পেল রুহান একটা বোল্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে পাগলের মতো হাত নাড়ছে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। লাইনা তার গাঢ় লাল রঙের স্কার্ফটা দিয়ে চুলগুলো পেছনের দিকে আরেকটু টেনে বেঁধে নিল। ঠিক তখনই আকাশ থেকে আবার অগোচরে নেমে এল শ্বেতশুভ্র এক অনুরণ গোলক। ভূমিস্পর্শ করামাত্র সেটা বিস্ফোরিত হলো। তীব্র তেজষ্ক্রিয়তায় ঝলসে যেতে লাগল সবকিছু। পুরো ব্যাপারটা ঘটল মাত্র ১৫ মিনিটে। মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহের অধিবাসীরা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখতে পেল তিল তিল করে গড়ে ওঠা মানবসভ্যতা কীভাবে মাত্র কয়েক মিনিটে পুরো পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। লাইনার আর রুহানের কাছে যাওয়া হলো না।
১.
পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ২০ বছর পরের কথা।
গ৫ক১ঞ১১৭ কোড নম্বরযুক্ত মানব বসতির এক কোণায় ক্রোমিয়ামের একটা স্তূপের গায়ে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে সুহান। চুপচাপ বসে থাকলেও তার হাত দুটো একটা অর্থহীন প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। একটু পর পর সে একটা করে পাথর তুলে নিয়ে সামনে ছুড়ে মারছে। পাহারায় অবস্তিত নিরাপত্তা রোবটগুলো সুহানের এই কর্মকাণ্ডকে নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ মনে না করায় এখনো কিছু বলেনি। তবে একটু পর পর তারা হাস্যকরভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে বিড়বিড় করে ‘মানুষ যে কেন অর্থহীন কর্মকাণ্ড করে শক্তির অপচয় করে বুঝি না' বলে চিন্তিত হওয়ার ভঙ্গি করে।
এখন বিকেল। বিষাদময় বিকেল। কোথা থেকে জানি কোলাহল ভেসে আসছে। সুহান একটু মনোযোগ দিয়ে বুঝতে পারল, কোলাহলটা আসছে খাবারের হলঘর থেকে। বিকেল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত একটা লাল পাস আর ২ ইউনিটের বিনিময়ে খাবার ঘর থেকে বিকেলের খাবার সরবরাহ করা হয়Ñবিষাধ চতুষ্কোণ একটা খাবার আর বোতলে করে একটু লাল পানীয়।
বিকেলবেলা খাবার সংগ্রহ না করা পঞ্চম মাত্রার অপরাধ। সুহানের একটুও ইচ্ছে করছে না খাবার সংগ্রহ করতে। তার অপরাধ করতে ইচ্ছে করছে। খাবার হলঘরের কোলাহলের কথা ভাবলেই তার মন বিষাদে ভরে যায়। মানুষের হৈ-হল্লা, নিু বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন কিছু রোবটের অর্থহীন ছোটাছুটি তার একদম ভালো লাগে না। সুহান একদম অন্ধকার না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেখানে অপো করল। চারদিকের জিনন ল্যাম্পগুলো জ্বলে উঠলে তার ভেতর দিয়ে সে আস্তে আস্তে বাসার দিকে রওনা দিল। বাসায় পৌঁছে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা চালু করল সে। চারদিকে মন খারাপ করা সব খবর ঝ৫গ৮ট২২ মানব বসতিতে ১৭ বছরের এক উচ্ছল তরুণী বাসার ছাদ থেকে লাফিয়ে আÍহত্যা করেছে। মৃত্যুর আগে সে এক টুকরো কাগজে লিখে রেখে গেছেÑএ জীবনকে দীর্ঘায়িত করার কোনো ইচ্ছা তার নেই। সুহান হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
খুট করে একটা আওয়াজে সুহানের ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই সে দেখতে পেল একজোড়া সবুজ ফটোসেলের চোখ তার থেকে পাঁচ ইঞ্চি দূরে স্থির হয়ে আছে।
সুপ্রভাত। আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত মহামান্য সুহান।
সুহান চমকে উঠল। কে কথা বলে? গম্ভীর গলা। গম্ভীর কিন্তু সুরেলা। স্বরের ভেতর কোথায় যেন সামান্য বিষাদমাখা। শুনতে শুধু যে ভালো লাগে তা-ই না, আরও শুনতে ইচ্ছা করে। সুহান শুয়ে থেকেই বলল, ‘তুমি কি রোবট, হলে কোন প্রজাতির?’
‘মহামান্য সুহান; আপনাকে আবারও সুপ্রভাত। আশা করছি আপনার সুনিদ্রা হয়েছে।’
‘তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। তুমি কে?’
‘আমি রোবট না, আমি একটা পরিব্যাপ্ত অপারের্টি সিস্টেম। এই মানব বসতির নিয়ন্ত্রণকর্তা। সবাই আমকে গ্র“স্টান নামে ডাকে।’
‘ও আচ্ছা তুমি! তোমার নাম আমি অনেক শুনেছি কিন্তু তোমাকে কখনো দেখিনি’Ñবলেই সুহান একটু অস্বস্তিতে পড়ল। গ্র“স্টানকে কি তুমি করে বলা উচিত হচ্ছে? সুহান বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনাকে তুমি করে বলায় আপনি কি রাগ করলেন? ‘না, রাগ করিনি। রাগ, বিস্ময়, ভালোবাসা জাতীয় মানবিক আবেগ থেকে আমি মুক্ত?’
‘মহামান্য সুহান, আজ বিকেলবেলা আপনি একটা পঞ্চম মাত্রার অপরাধ করেছেন। আপনি আপনার খাবার সংগ্রহ না করে মানব বসতির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। আমি আপনাকে পঞ্চম মাত্রার শৃঙ্খলা ভঙ্গের শাস্তি দিতে এসেছি।’
‘পঞ্চম মাত্রার অপরাধের শাস্তি কী?’
‘মানব বসতির সংবিধান অনুযায়ী পঞ্চম মাত্রার অপরাধের শাস্তি হলো বনবাস।’
‘বনবাস? সেটা তো শুনেছি পৌরাণিক আমলের ব্যবস্থা।’
‘হ্যাঁ, বনবাস। তবে বন বলে এখন কোনো জিনিসের অস্তিত্ব নেই বলে আপনাকে আমরা মানব বসতির বাইরে রেখে আসব।’
সুহান হাহাকার করে উঠল, ‘এটা অসম্ভব!’
‘অবশ্যই সেটা সম্ভব এবং সেটা এখনই। আপনি তৈরি হয়ে নিন মহামান্য সুহান। আমরা আপনার প্রতি একটু সদয় হয়েছি। আপনাকে একটা রোবট দেওয়া হচ্ছে সঙ্গী হিসেবে।’
এর একটু পরেই বাই ভার্বাল এসে সুহানের বাসার সামনে থামল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেটিকে আবার সুহানকে নিয়ে পশি।চম দিকে উড়ে চলে যেতে দেখা গেল।
২.
বাই ভার্বলটি সুহানকে যে জায়গায় নামিয়ে দিয়ে গেছে সে জায়গাটির নাম ছিল ঢাকা, বাংলাদেশ নামে একটি দেশের রাজধানী।
এখানে আসার পঞ্চম দিন সকালবেলা, সুহান তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। সঙ্গে দিয়ে দেওয়া রোবটটি অস্থিরভাবে সুহানের গা ঝাঁকি দিতে দিতে বলল, ‘মহামান্য সুহান, দ্রুত উঠুন, আমি সম্ভবত একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করেছি।’
সুহান ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠল। তারপর ছুটল রোবটটির পেছনে পেছন। হাজির হরো একটা অর্ধভগ্ন হলঘরে। সেখানে সারি সারি সাজানো টেপ। সুহান বুঝতে পারল এটা কোনো আর্কাইভ ভবন। একটা টেপ হাতে নিয়ে সে তার উপর ছোট ছোট অরে লেখা দেখতে পেলÑ ৮টার সংবাদ, বাংলাদেশ টেলিভিশন, রামপুরা, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সুহান দেখল অধিকাংশ টেপই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক খুঁজে পেতে সে ১৯৯৭-৯৮ এবং ২০০২-২০০৩ সালের ৫০০ টেপ উদ্ধার করল। রোবটটি নির্দেশ দিল সেগুলোকে দ্রুত বিশ্লেষণ করতে।
প্রথমে বিশ্লেষণ করা হলো ১৯৯৭ সালের ৫০টি টেপ। সেগুলোর সবগুলোতে দেখা গেল ৮টার সংবাদ শুরু হওয়ার আগে একজন লোক আঙুল তুলে বিশাল এক জনসমাবেশে সামনে ভাষণ দিচ্ছেন। তারপর খবর চলাকালীন পুরোটা সময় কালো রঙের হাফ-হাতা ড্রেস পরা একদল লোক খালি কাচি দিয়ে ফিতা কেটে কিছু একটা উদ্বোধন করছেন।
এবার ২০০৩ সালের ৫০টি টেপ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেল ভিন্ন চিত্র। এখানে খবর শুরুর আগে ওই হাত উঁচু করা শোকের ভাষণটি উধাও। আর প্রতিটি টেপেই একই খবর একজন সংবাদ পাঠিকা প্রতিদিন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশ এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে...তিনি আরও বলেন...’ সুহান ও রোবটটি গালে হাত দিয়ে বসে পড়ে। তারা বুঝতে পারে না একটি দেশ কীভাবে প্রতিদিনই উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে পারে।
প্যারডিটি ২০০০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে আলপিনের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন