সিমু নাসের
আজ ২১ আগস্ট প্রিয় (রম্য ক্যাটাগরিতে) লেখক (এটা বললে তিনি খুশি হন, তাই বলা) আশীফ এন্তাজ রবির জন্মদিন। কততম জানি না। মানুষ মারা টারা গেলে আশেপাশের ভক্তরা তাকে নিয়ে স্বরনসভা করে, স্বরনিকা বের করে। কিন্তু রবি অন্যদের কারো ওপরই ভরসা রাখতে পারেন নাই। তাই তিনি তার এই জন্মদিনেই একটা স্বরনিকা প্রকাশ করেছেন। প্রকাশ উপলক্ষে তার যোগ্য শিষ্য ইশতিয়াক গুণ্ডা লাগিয়ে আমার কাছ থেকে এই লেখা আদায় করেছেন। ইন ফ্যাক্ট আইডিয়াটা আমার পছন্দ হয়েছে। রবি ভাই এখনো বেঁচে আছেন বলে মনের সুখ মিটিয়ে এখানে কিছু লেখা গেল না। উনি কথা দিয়েছেন এই মায়ার জগতে তার বেশি দিন থাকার ইচ্ছা নাই। দেখা যাক কবে নাগাদ 'আশীফ এন্তাজ রবিকে যেমন দেখেছি' লিখতে হয়। তবে তার আগে যদি তাকে লিখতে হয় 'সিমু নাসেরকে যেমন দেখেছি' তাইলে আমি শেষ। আচ্ছা, এসব হৃদয় বিদারক কথা বাদ দিয়ে আপনারা সবাই মিলে রবি ভাইয়ের এই জন্মদিনে আমাদের দুজনেরই দীঘায়ু কামনা করতে পারেন।]
৬ মে ১৮৬১। সকাল থেকেই কলকাতার অলিতে গলিতে তারস্বরে চেচাতে লাগল সিটি কর্পোরেশনের কয়েকশত মাইক, ‘ভাইসব, ভাইসব। একটি বিশেষ ঘোষণা। এতদ্বারা সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, ন্যাশনাল গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় আগামীকাল ৭ মে সারাদিন কলকাতায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ থাকিবে। ভাইসব, ভাইসব...।
এই খবরে কলকাতাবাসীর মুখে আঁধার ঘনিয়ে এল। গোমস্তাবাড়ীর পুরুত মশাই জি বাংলায় 'ডান্স বাংলা ডান্স' দেখতে পারবেন না বলে হা হুতাশ শুরু করলেন, খগেন মুখার্জী তাৎনিকভাবে দুটি কড়া পোস্ট আপ করলেন সামহোয়ার ইন ব্লগে, মূহুর্তের মধ্যেই কমেন্টসে কমেন্টসে ভরে ওঠল পোস্ট, লাবন্য চ্যাটার্জী মুখ ভার করে তার নকিয়া এন সেভেন্টি সেটটা চার্জ দিতে বসল। সবেই শিলং থেকে এসেছে সে। সেখানে বাংলা সিনেমার মতো অসাবধানে ধাক্কা খেয়ে পরিচয় হয়েছে অমিত রায়ের সঙ্গে। তাকে ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছে লাবন্য। অমিত কথা দিয়েছে এফএনএফ অ্যাকটিভ হওয়ার পরেই ফোন দেবে সে লাবন্যকে। আগামীকালই এফএনএফ অ্যাকটিভ হওয়ার ২৪ ঘন্টা শেষ হবে।
বিদ্যুত না থাকার এই খবরেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই কেবল জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়ির দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা দেবীর। এক সপ্তাহ আগে দেবেন্দ্রনাথ সারাদাকে নিয়ে গিয়েছিল ল্যাব এইডে। দশ মাসের পোয়াতী বউটার খুব শখ হয়েছিল গর্ভের সন্তান ছেলে হয় না মেয়ে হয় জানার। ডা. সবিতা ব্যানার্জির (এমডি. গাইনোকলজি ও অবস, এমএবিটি) পরামর্শে একটা থ্রিডি আলট্রাসনোগ্রাম করে তারা জানতে পেরেছে ছেলে হচ্ছে। আনন্দ আর ধরে না তাদের মুখে। দুজনে মিলে নামও ঠিক করে ফেললেন, হয় চান মিয়া না হয় শুধুই রবি। অবশেষে দিনের বেলায় চাঁদের পাওয়ার কম থাকে বলে রবি নামই ঠিক করলেন তারা।
৭ মে। চারদিকে যখন ঘোর অন্ধকার তখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর সারদা দেবীর ঘর আলো করে জন্ম নিল রবি। সে কি যে সে আলো। ইডেন গার্ডেনে তখন খেলা চলছিল ভারত, অস্টেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রিদেশীয় সিরিজের রবিন লীগের তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচ। বিদ্যুত বিভ্রাটের এই সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট কর্তৃপ সেই শিশু রবিকেই নিয়ে বসিয়ে দিলেন ফাডলাইটের জায়গায়।
যাই হোক ইশকুলের পড়া একেবারেই পছন্দ ছিল না শিশু রবির। কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্সে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে পর্যায়ক্রমে। কিন্তু সুন্দরী কোন বালিকা সহপাঠী না থাকায় স্কুলে যাওয়াতে তাঁর ছিল ব্যাপক আপত্তি। স্কুলের ধরাবাঁধা নিয়মও তাঁর পছন্দ হতো না। ফলে বন্ধ হয়ে গেল স্কুলে যাওয়া। বাড়িতেই পড়াশোনা তখন। পড়াতে আসতেন বুয়েট, মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ার অথবা সেকেন্ড ইয়ারের মেয়েরা, শেখাতেন সংস্কৃত, গণিত, ইংরেজি সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, হস্তবিদ্যা, শারীরবিজ্ঞান, আরও কত কী! অন্যদিকে চলতে থাকে ছবি আঁকা, গান শেখা, ব্যায়াম আর আরএমজি পড়া। আর হ্যাঁ, চলতে থাকে কবিতা লেখাও। ১৮৮৪ সালেই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘অভিলাষ’ ছাপা হয়। সেখানে তিনি মেডিকেলে পড়–য়া গৃহশিকিা সুজাতার সঙ্গে প্রেম করার অভিলাষের কথা বয়ান করেন। কত যে গান লিখেছেন রবি। কত যে নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস! কত যে ছবি এঁকেছেন, কত যে লিখেছেন চিঠি! কত যে প্রেম। ভাবি থেকে শুরু করে তরুনী ভক্ত, কাউকেই বাদ দেননি তিনি।
খুব পূণর্জন্মে বিশ্বাস করতেন তিনি। এবং বিশ্বাস করতেন এই জন্মের পাপের ফল পরবর্তী জন্মে ভোগ করতে হয় মানুষকে। সেটা যে হাড়ে হাড়ে সত্য তা এখন টের পাচ্ছি আমরা। আগের জন্মে তিনি এত লোককে হৃদয় বিলিয়েছিলেন যে এই জন্মে তিনি এখন কঠিন হার্টের রোগী। ওই জন্মে তিনি ভিলেন হয়েছিলেন 'লা নুই বেঙ্গলীর' মির্চা এলিয়াদের, সেই পাপে নোবেল বিজয়ী কবি থেকে এখন তিনি ফান ম্যাগাজিনের সম্পাদক।
তাই সাবধান হওয়ার সময় এখনই। এই জন্মদিনে সেই রবির কাছে প্রত্যাশা, না নিজের বউ ছাড়া আর কোন প্রেম নয়, নয় সুন্দরী মেয়েদের দিকে আড়চোখে তাকানো, নয় নিজেকে হস্তরেখা বিশারদ দাবী করে সুন্দরী লেখিকাদের হাত দেখে দেওয়া, নয় 'এটাই লাস্ট সিগারেট' বলে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে ফেলা। এসব পাপ খোদাও সহ্য করবেন না। সেই পাপ মোচন করাতে খোদা হয়তবা তাকে পরবর্তী জন্মে পৃথিবীতে পাঠাবেন ফান ম্যাগাজিন রস+আলোর সুন্দরী, ষোড়শী, চমৎকার ফিগারের এক তরুণী কন্ট্রিবিউটর হিসেবে। আর আমি সেই ম্যাগাজিনের সম্পাদক হয়ে লেখা ছাপার আশ্বাস দিয়ে তার হাত দেখে দেব দুই তিন ঘন্টা ধরে--নিরালায়।
লেখাটি ২০০৯ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে লেখা। এটি রবি স্মরনিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর একযোগে এটি সামহোয়ারইনব্লগ, প্রথম আলো ব্লগে প্রকাশিত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন