এটি হুমায়ূন আহমেদের ‘শুভ্র’ চরিত্রের প্যারডি। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে আছে হিমু ও মিসির আলী। হুমায়ূন আহমেদের প্যারডিটি লিখেছেন সিমু নাসের
‘মা, আমার চশমা, আমার চশমা কোথায়, মা?’শুভ্র হাহাকার করে উঠল। গতরাতে আলপিন পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা খেয়ালই করেনি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরপরই তার খেয়াল হলো, আলপিনটি সে জায়গামতো লুকাতে ভুলে গেছে। এর মধ্যে আবার বোকার মতন মাকে ডেকে ফেলল সে। মা যদি বিছানায় আলপিন দেখতে পান, তাহলে তিনি হতভম্ব হয়ে যাবেন।
শুভ্রর মা জাহানারার ধারণা, তাঁর ছেলে আইনস্টাইন। ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিকসের বই ছাড়া আর কিছু পড়ে না। কিন্তু শুভ্র যে গোপনে গোপনে আলপিন, সেলিনার গোপন কথা, ভালোবাসা প্রেম নয়, বোরকা পরা সেই মেয়েটি ধরনের বইও পড়ে; এটা জানতে পারলে তিনি ছোটখাটো একটা স্ট্রোক করবেন। তাই শুভ্র এ-জাতীয় বই সব সময় লকারে লুকিয়ে রাখে। মা স্ট্রোক করুন, এটা সে চায় না।
ছেলের ডাক শুনে জাহানারা রুমে ছুটে এলেন। গাঢ় মমতা নিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন তিনি। কী অদ্ভুত ভঙ্গিতেই না সে বিছানার এদিক-সেদিক চশমা খুঁজছে। দিনের প্রথম ভাগে সব মানুষকেই সুন্দর লাগে, সেখানে শুভ্রকে দেবদূতের মতো লাগছে। জাহানারা কাজের মেয়েকে ডাকলেন, ‘সকিনা!’
‘জি, আম্মা।’
‘শুভ্রর মতো সুন্দর ছেলে কি তুমি তোমার জীবনে দেখেছ?’
‘জি, না।’
‘আমাকে খুশি করার জন্য কোনো কথা বলবে না। খুশি করানো কথা আমার পছন্দ না। সত্যিটা বলো।’
‘ভাইজানের মতো এমন লালটু মার্কা সুন্দর ছেলে আমি দেখিনি মা। তিনি বিশ্বসুন্দর প্রতিযোগিতায় হেসেখেলে ফার্স্ট হবেন। আর প্যাকেজ নাটকের নির্মাতারা তো তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি ফেলে দেবেন। আম্মা, ভাইজান প্যাকেজ নাটকে অভিনয় করেন না কেন? কী সুন্দর শমী, বিপাশা, অপি করিমদের হাত ধরে ভালোবাসার ডায়ালগ ছাড়তে পারতেন!’
জাহানারা থমথমে গলায় বললেন, ‘সকিনা, তুমি কি আমার সঙ্গে মশকরা করছ?’
‘জি, আম্মা।’
‘ফাজিল মেয়ে! তুমি কি জানো, এক থাপ্পড় দিয়ে আমি তোমার বত্রিশটা দাঁত ফেলে দিতে পারি?’
‘জানি বলেই তো মশকরা করছি, আম্মা। সকাল থেকে মাড়ির দুটা দাঁত ব্যথা করছে। আপনার থাপ্পড় খেয়ে যদি পড়ে, তাহলে ডেন্টিস্টের খরচ বেঁচে যাবে।’
সকিনা প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো।
জাহানারা বললেন, ‘তুমি যাচ্ছ কোথায়, সকিনা! দেখছ না, তোমার ভাইজান ঘুম থেকে মাত্র উঠেছে। তাকে এক গ্লাস ট্যাং বানিয়ে দাও, গরম পানিতে ট্যাং। শীতের সময় এলেই প্রতিদিন সে গরম পানিতে ট্যাং খায়, এটা তুমি ভুলে যাও কেন?’
জাহানারা দরজা ছেড়ে কাছে এসে শুভ্রকে বললেন, ‘কিরে বাবা, চশমা খুঁজে পাচ্ছিস না? দাঁড়া, তোর বাবাকে বলে কন্টাক্ট লেন্স কিনে দিতে হবে। আচ্ছা, কন্টাক্ট লেন্স কোথায় পাওয়া যায়, কত দাম-এসব কি জানিস তুই?’
শুভ্র লাজুক গলায় বলল, “লাস্ট সংখ্যা নকশায় ‘কন্টাক্ট লেন্সের খোঁজ-খবর’ নামে একটা ফিচার এসেছিল। ওখানেই সব লেখা আছে। তুমি দেখতে পারো। আমি কেটে রেখে দিয়েছি।”
জাহানারা এবার সত্যি সত্যিই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। শুভ্র এসব কী বলছে! শুভ্র নকশা পড়বে কেন? শুভ্র কি ইদানীং কঠিন কঠিন বই পড়া বাদ দিয়ে নকশা পড়া শুরু করেছে? তিনি বিচলিত বোধ করছেন। ঠিক তখনই বাসার কলবেল বেজে উঠল। জাহানারা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘দাঁড়া বাবা, আমি দরজাটা খুলে আসি।’
জাহানারা দরজা খুলতেই দেখলেন, হলুদ পাঞ্জাবি পরা এক দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের সঙ্গে শুকনোমতো বয়স্ক একটা লোক কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ পাঞ্জাবিওয়ালাই প্রথম কথা বলে উঠল, ‘জাহানারা খালা, আমাকে চিনতে পারোনি, আমি হিমু। ভালো নাম হিমালয়। বিশ্বাস না হলে ম্যাট্রিকুলেশনের সার্টিফিকেট দেখাতে পারি। ওই যে একবার তোমার হাত দেখে দিলাম।’
জাহানারা শুকনো গলায় বললেন, ‘ও!’
‘আর ইনি হচ্ছেন মিসির আলী। বিশিষ্ট সাইকিয়াট্রিস্ট। লজিক নিয়ে কাজ করেন। আর আমি কাজ করি অ্যান্টিলজিক নিয়ে। চিনতে পেরেছ?’
জাহানারা আবার শুকনো গলায় বললেন, ‘ও, আচ্ছা!’
মিসির আলী বিরক্ত মুখে হিমুর দিকে তাকালেন। এই ছেলে এত কথা বলছে কেন?
তিনি জাহানারার দিকে তাকালেন। চল্লিশের মতো বয়স। চোখের নিচে কালি পড়েছে। অযথাই টেনশন করেন। একটু আগে কান্নাকাটি করেছেন বোঝা যাচ্ছে। চোখ পিটপিট করছে। চোখের অশ্রুগ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করলে চোখ পিটপিট করে।
হিমু আবার খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘খালা চিনতে পারোনি?’
‘হ্যাঁ, পেরেছি! তুই ভবিষ্যৎ বলতে পারিস।’
যাক, শেষ পর্যন্ত খালা তাকে চিনতে পেরেছে। না পারলে মিসির আলীর সামনে বেইজ্জতি হতে হতো। কালকেই কোনো রিকশাওয়ালাকে পাঁচ টাকা ভাড়ার বদলে পাঁচ শ টাকার চকচকে একটা নোট গিফট করতে হবে।
তুই এমন হনুমানের মতো দাড়ি রেখেছিস কেন?’
‘হনুমানের দাড়ি থাকে নাকি খালা? ইন্টারেস্টিং তথ্য তো। কী বলেন স্যার?’ বলে সে মিসির আলীর দিকে তাকাল। মিসির আলী হাসতে গিয়ে আরেকটু কুঁজো হয়ে গেলেন। জাহানারা বললেন, ‘আছে কি না জানি না। তোকে যে হনুমানের মতো দেখাচ্ছে এটা জানি।’
‘চট করে দশটা টাকা বের করো তো খালা। সেলুন থেকে সেভটা খতম করে আসি।’
জাহানারা রাগে কটমট করে হিমুর দিকে তাকালেন। “যাক, বাদ দাও খালা। দাড়ি থাকলেই বরং চেহারায় একটা মহাপুরুষ-মহাপুরুষ ভাব আসে। ও আচ্ছা, যে কারণে এসেছি। খালা, শুভ্র কি বাসায় আছে? আজকে আমাদের এলাচি দ্বীপের ট্যুর-সংক্রান্ত একটা মিটিং আছে। এ ছাড়া ব্যবসায়িক আলোচনাও হবে। আমরা তিনজন মিলে ‘চলো যাই আমেরিকা’ নামে একটা কোম্পানি খুলেছি। ১০০ টাকার বিনিময়ে ইন্টারনেটে ডিভি ফরম পূরণ করার কোম্পানি। শুভ্র এটার ৫০% পার্টনার। আমি আর মিসির আলী স্যার ২৫% করে।”
জাহানারা আবার চোখে অন্ধকার দেখলেন। কই, এসব কথা তো শুভ্র তাঁকে বলেনি। সারা দিন খালি বাপের সঙ্গে গুটুর গুটুর। জাহানারা নিজেকে সামলে নিয়ে ওদের ভেতরে আসতে ইশারা করলেন। তারপর শুভ্রর রুম দেখিয়ে বললেন, ‘যা, শুভ্রর রুমে চলে যা। আর শোন, শুভ্র ওর চশমাটা খুঁজে পাচ্ছে না। তুই কি ওর চশমাটা খুঁজে পেতে হেলপ করবি?’
হিমু হেসে বলল, ‘খালা, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। আমরা খুঁজে দেব। আমরা দুজন খুঁজে না পেলে বাংলাদেশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্দান্ত-দুঃসাহসী স্পাই মাসুদ রানাকে ভাড়া করব। প্রয়োজনে সিআইএকে খবর দেব। সিআইএর প্রধান আমার ঘনিষ্ঠ আÍীয়। আমার কথা শুনলেই বাপ-বাপ করে চলে আসবে শুভ্রর চশমা খুঁজে দিতে।’
জাহানারা আবার রাগী গলায় বললেন, ‘খবরদার, আমার সঙ্গে ফাজলামি করবি না।’
‘জি আচ্ছা।’ বলে হিমু মিসির আলীকে নিয়ে শুভ্রর রুমের ভেতর চলে গেল।
ওদের দেখেই শুভ্র বলল, ‘আরে হিমু ভাই আর মিসির আলী স্যার যে। ইস! হিমু ভাই তোমার দাড়িগুলো যা সুইট লাগছে না! সরি, আমি ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি করে ফেলেছি। গতকাল রাতে ঘুমাতে একটু বেশি দেরি করে ফেলেছিলাম। একটা বই পড়ছিলাম।’
মিসির আলী মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বই শুভ্র?’
শুভ্র একটু বিব্রত হয়ে বলল, ‘না না, মানে, না, ওটা হলো কোয়ান্টাম ফিজিকসের একটা বই।’ ‘ও আচ্ছা।’ মিসির আলী স্পষ্টতই বুঝলেন, শুভ্র মিথ্যে কথা বলছে। কারণ, মিথ্যে বলার সময় রক্তচাপে তারতম্য হয়। ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। কণ্ঠ জড়িয়ে যায়। মিসির আলী বললেন, ‘তোমার মায়ের কাছে শুনলাম, তুমি নাকি চশমা খুঁজে পাচ্ছিলে না? দেখি, আমরা খুঁজে দেখি। দুজনে এদিক-ওদিক চশমা খুঁজতে লাগল। এমন সময় বিছানার ওপর পাতলা আকারের একটা ম্যাগাজিন পেয়ে হিমু সেটা হাতে নিতেই তার মুখের চেহারা যেন বদলে গেল। হিমু চোখ কপালে তুলে বলল, ‘শুভ্র, তুই ইদানীং আলপিনও পড়িস নাকি।’
শুভ্র অপ্রস্তুতভাবে বলতে লাগল, ‘না, না, ওটা আমার না। কোথা থেকে এসেছে আমি জানি না। এসব ফালতু জিনিস আমি পড়ি নাকি? মনে হয় মায়ের কাণ্ড।’
মিসির আলী মৃদু হাসলেন। তার কিছুণ পর তারা তিনজনই এলাচি দ্বীপে যাওয়ার প্ল্যান করতে বসলেন।
পরিশিষ্ট
এক মাস পরের ঘটনা। মিসির আলীর শরীর খারাপ সত্ত্বেও হিমু আর শুভ্রর টানাটানিতে বাধ্য হলেন শেষ পর্যন্ত এলাচি দ্বীপে আসতে। এলাচি দ্বীপে এসে তিনি অভিভূত। চারদিকে গৃহত্যাগী জ্যোৎনা। এর মধ্যে তাঁরা এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ান। একদিন হিমু জ্যোৎনা দেখার অভিনব একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করল। বুক পর্যন্ত মাটির নিচে পুঁতে জ্যোৎনা দেখা নাকি খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। শুভ্র হিমুর এককথায় রাজি। হিমুর সঙ্গে কাপড়চোপড় খুলে গর্তে বসে জ্যোৎনা দেখায় তার অসীম আগ্রহ। কিন্তু মিসির আলী কোনো আগ্রহই বোধ করছেন না। তিনি গলে গলে পড়া গৃহত্যাগী জ্যোৎনায় একা একা হাঁটেন আর ভাবেন, তিনি মারা গেছেন। শবদেহ বিছানায় পড়ে আছে, একজন কেউ গভীর অন্বেষণে গাইছে, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়...’
লেখাটি আলপিনের ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন