মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্যারডি লিখেছেন সিমু নাসের
বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি ত্রাসিয়ান রুথ গ্রানাইটের হলঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে বিষন্ন হয়ে পড়লেন। প্রায় আকাশছোঁয়া কালো গ্রানাইটের হলঘরটি আগে বিজ্ঞান আকাদেমির মূল তথ্যকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নিনীষ স্কেলে নবম মাত্রার বুদ্ধিমান প্রাণী এনরয়েডরা এটা তৈরি করেছিল। এখন হলঘরটি পরিণত হয়েছে মানব বসতির বিনোদনকেন্দ্রে।
ত্রাসিয়ান রুথের অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ল। সেই ইন দ্য ইয়ার থ্রি থাউজেন্ড ওয়ান। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকেন্দ্রের পরিচালক, মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক সবাই মিলে একসঙ্গে বসে লাল বিষাদ তিন মাত্রার উত্তেজক পদার্থ খেয়ে এই হলঘরটিতে মাতলামি করছেন। আর স্বপ্ন দেখছেন, মূল ডেটাবেইজ কম্পিউটার সিডিসিকে ধ্বংস করে ফেলবেন। দশম প্রজাতির রোবটগুলো বেইমানি না করলে তা অবিশ্যি সম্ভব হতো।
বড় হলঘরটিতে মানব বসতির লোকেরা আসতে শুরু করেছে। এখন সন্ধ্যা। হলঘরটির চারপাশে জিনন ল্যাম্পের আলোয় কেমন জানি অপার্থিব লাগছে। ক্রিশি ও রাইনা হাত ধরাধরি করে ভেতরে ঢুকে গেল। ত্রাসিয়ান রুথ সেটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। খাদ্য কাউন্টারে বেশ ভিড়। খাদ্য কাউন্টারে কর্মরত কর্মী রোবটগুলো অহেতুক এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। তাদের হাতে একটা ট্রে। তাতে চতুষ্কোণ এক প্রকার খাবার আর লাল রঙের এক প্রকার পানীয়। খাবারগুলো বিস্বাদ কিন্তু খাওয়ার পর দেহমনে কেমন জানি এক প্রকার চাঞ্চল্য ফিরে আসে। সবাই পাঁচ ক্রেডিটের বিনিময়ে খাবার তুলে নিচ্ছে।
কিছুণ পরেই বিনোদনকেন্দ্রের অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে। অনুষ্ঠান বলতে বিনোদন রোবট সি-২৫ কিছুণ ভাঁড়ামো করবে। উত্তেজক পদার্থ পান করার ফলে সেই ভাঁড়ামো দেখেই সবাই হেসে গড়াগড়ি দিতে থাকবে। তারপর আসবে গায়ক রোবট এলআর ২০। সে কিছুণ যান্ত্রিক গলায় মাধুর্য এনে কিমি সংগীত১ গাইবে।
তবে আজ নাকি বিনোদনের একটি বিশেষ ব্যবস্থা আছে। সবাই আজ তাই হলঘরে এসে ভিড় করছে।
বেশ কিছুদিন আগের কথা। অনুসন্ধানী রোবটের কয়েকটি দলকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়েছিল আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের জন্য। দুটি দল গিয়েছিল এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। ডেটা প্রসেসিং সফটওয়্যারে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় একটি দল মিশন শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময়ের আগেই মানব বসতিতে ফেরত আসে।
‘এক্সপ্লোরার’ নামের সেই দলটির মিশন রিপোর্টের একটা অংশ ছিল এ রকম, তারা ইন্ডিয়ান ওশানের আশপাশের বিস্তৃত ভূখণ্ডগুলোয় সার্ভে করে কিছু জায়গায় অতীতে নগরায়ণের সুস্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পায়। স্থানে স্থানে ক্রোমিয়ামের বিশাল স্তূপ, বোল্ডার এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বিশেষভাবে একটি জায়গায় খননকার্য চালিয়ে তারা অনেকগুলো গোল চাকতির মতো জিনিস আবিষ্কার করে। ধারণা করা হচ্ছে, সেই চাকতিগুলোয় তৎকালীন মানব সম্প্রদায়ের ভিডিও ফুটেজ সাউন্ড ট্র্যাকসহ অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। তৎকালীন মানব সম্প্রদায় এগুলোকে ভিসিডি নামে ডাকত। এই মানব বসতির কমিউনিকেশন টেকনিশিয়ানরা দিন-রাত পরিশ্রম করে গোল চাকতির মতো জিনিসগুলোকে বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁরা আবিষ্কার করেছেন, এই গোল চাকতির মতো জিনিসগুলো, যেগুলোকে ভিসিডি বলা হতো, সেগুলো ছিল তৎকালীন নিচু বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বিনোদনের বস্তু। সাজানো একটা ঘটনাকে তাঁরা তিন ঘণ্টা সময়সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছেন এবং প্রত্যেকটি ঘটনাকে তাঁরা নামকরণ করেছেন। আজ হলঘরের হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে যে ভিসিডিটি প্রদর্শন করা হবে, এর নাম ‘কহো না পেয়ার হ্যায়।’
বড় হলঘরটিতে এখন মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। তারা এতক্ষন সি-২৫-এর ভাঁড়ামো দেখে হেসেছে, তারপর মনোযোগ দিয়ে কিমি সংগীত শুনেছে। এখন তারা অপো করছে আদিম মানুষের ভিসিডি দেখার জন্য।
কমিউনিকেশন টেকনিশিয়ান লিয়ানা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটার পাশে দাঁড়াল। তার পরনে অর্ধ স্বচ্ছ নিও পলিমারের আবরণ। চমৎকার সুন্দর তার শরীর। মসৃণ ত্বক আর তার দেহের বাঁকগুলো এত স্পষ্ট যে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সবাই রুদ্ধশ্বাসে লিয়ানার দিকে তাকিয়ে আছে।
লিয়ানা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথাটা একটু ছোট্ট করে ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আমরা আজ যে সাউন্ড ট্র্যাকসহ ভিডিও ফুটেজটি দেখব, তা মূলত হিন্দি ভাষায়। মানব বসতির সবার সুবিধার্থে গানের দৃশ্যগুলো ছাড়া বাকি অংশ আমাদের নিজস্ব রিকিভ ভাষায়২ রূপান্তর করা হয়েছে।’ এই বলে সে নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে ঘরের মাঝামাঝি একটা নীলাভ আলো ফুটে ওঠে।
এর ঠিক কিছুণ পরেই হলঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি ত্রাসিয়ান রুথ শুনতে পান, হলঘর থেকে অদ্ভুত বিজাতীয় একটা যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে ভেসে আসছে বিজাতীয় একটা ভাষার কিছু কথা, ‘দেখা তুমকো যাবছে, বাস দেখা তুমকো ইয়ারা...ক্যাহদিয়া ক্যাহদিয়া হউ আর মাই সোনিয়া...।’ ত্রাসিয়ান রুথ বুঝতে পারেন না এর মানে কী কিন্তু তিনি গানের মাধুর্যে চোখ বুজে ফেলেন।
নির্ঘণ্ট: ১. কিমি সংগীত: তিন হাজার সালের শুরুর দিকে জন্ম নেওয়া কিমি নামের একজন প্রতিভাবান শিল্পীর লেখা ও সুর করা সংগীত।
২. রিকিভ ভাষা: ভবিষ্যতে মানব সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত ভাষা। এই ভাষাকে মাতৃভাষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছিল ‘রিকি’ নামের এক উচ্ছল তরুণ।
এই লেখাটি প্রথম আলোর রম্য ও বিদ্রুপ ক্রোড়পত্র 'আলপিন' এর ইদ সঙখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন