হুমাযূন আহমেদের প্যারডি লিখেছেন সিমু নাসের
আজকের দিনটা এত সুন্দর কেন?সকালবেলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব। এ কি! আমার মুখে এত দাড়ি এল কোত্থেকে? সে দিনই তো গ্রিন ফার্মেসির পাশের ফুটপাতের সেলুন থেকে শেভ করলাম। আর এত অল্প দিনেই এত দাড়ি উঠে গেল? আচ্ছা, মানুষের দাড়ি প্রতিদিন কত সেন্টিমিটার করে বাড়ে? বাদল থাকলে জিজ্ঞেস করা যেত। অবশ্য বাদলকে একটা ফোন করে জানা যায়। আজ সোমবার, এতক্ষণে বড় ফুপা অফিসে চলে গেছেন। ফোন করলে বাদলকে পাওয়ার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি। অবশ্য দাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে ভালোই তো লাগছে। চেহারায় একটা মহাপুরুষ মহাপুরুষ ভাব চলে এসেছে।
দাড়িগুলো আর না কাটলে কেমন হয়? দেখতে দেখতে ইয়া লম্বা হয়ে যাবে। প্রথমে কিছুদিন চুলকাবে, তারপর জটা পাকিয়ে বুকে নামবে, বুক থেকে হাঁটুতে। রাস্তাঘাটে লোকজন দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। গিনেজ বুকের লোকেরা আমার এই মেসে এসে ইন্টারভিউ নেবে। তাতে কী? আর তা ছাড়া আমি তো হিমু। হিমুর কিছু তো ব্যতিক্রম থাকবেই। আমি তাকিয়ে আছি আমার গিজগিজ করে থাকা দাড়িগুলোর দিকে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরদিন যে ভঙ্গিতে কিশোরী মেয়েরা হাঁটে, অবিকল সেই বড় হয়ে গেছি ভঙ্গিতে।
মাথার ওপর ঝাঁঝালো রোদ, লু হাওয়ার মতো গরম হাওয়া বইছে। গায়ের হলুদ পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে একাকার। পাঞ্জাবি থেকে ঘামের গন্ধ তো আসছেই, সেই সঙ্গে দাড়িও চুলকাচ্ছে। বাংলাবাজার যাচ্ছিলাম, গুলিস্তানে ট্রাফিক জ্যামে পড়লাম। রিকশা, টেম্পো, বাস, ঠেলাগাড়ি-সবকিছু মিলিয়ে দেখতে দেখতে জট পাকিয়ে গেল। এক্কেবারে কঠিন গিট্টু।
জ্যাম কমছে না। কমানোর চেষ্টাও কেউ করছে না। রোগা ধরনের এক ট্রাফিক পুলিশ দূরে দাঁড়িয়ে বাদামওয়ালার সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। এই তো দেখি সে বাদাম কিনছে। এক ঠোঙা বাদাম, একটু ঝাল-লবণ। আমার রিকশা ঘেঁষে একটা পাজেরো দাঁড়িয়ে। পাজেরোর ড্রাইভার খুব মজা পাচ্ছে। একবার সে উঁচু গলায় বলল, ‘লাগছে গিট্টু!’ রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আমি রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে ট্রাফিক পুলিশ ট্রাফিক পুলিশ মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর পাজেরো টাইপের দামি কোনো গাড়ি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলি, ‘দেখি লাইসেন্সটা, ইন্স্যুরেন্সের কাগজপত্র আছে? ফিটনেস সার্টিফিকেট? কিছু না থাকলে কিন্তু খবর আছে। আমার রেট সার্জেন্ট থেকে বেশি। এক কার্টন বেনসন।’
আজকের দিনটা এমন যে ইচ্ছেটা তৎক্ষণাৎ পূর্ণ হলো। একটা পাজেরো গাড়ি আমার গা ঘেঁষে হুড়মুড় করে থামল। আরেকটু হলে আমার ওপর উঠে যেত। আমি কড়া দৃষ্টিতে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। এ দৃষ্টিকে সাধু পুরুষদের ভাষায় বলা হয় ‘ভস্মদৃষ্টি’। কিন্তু আমার দৃষ্টি নরম হয়ে এল। গাড়ির পেছনের সিটে মধ্যবয়স্ক এক মহিলার সঙ্গে রূপবতী তরুণী বসে আছে। গায়ের রং দুধ-আলতা টাইপের। চেহারায় কেমন জানি মায়াবতী মায়াবতী ভাব। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। মেয়েটির চোখ দুটি নিশ্চয়ই সুন্দর, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না, কালো সানগ্লাসে ঢাকা। কোলের ওপর ম্যাগাজিন টাইপের কী জানি একটা। সানগ্লাস পরে এর আগে আমি কাউকে ম্যাগাজিন পড়তে দেখিনি। এটা কি বিশেষ কোনো ম্যাগাজিন, যা সানগ্লাস ছাড়া পড়া যায় না?
মেয়েটার চোখ দুটো দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে যদি মেয়েটার চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিই, তাহলে কী হবে? মেয়েটা সত্যিই ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠবে। আগুন আগুন বলেও চেঁচাতে পারে। তখন আমি জিপি-জিপি মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলব, ‘ম্যাডাম, প্লিজ কুইক, ফায়ার সার্ভিসের নম্বরটা বলুন, আমি ফোন করছি।’
পাজেরোর গ্লাস নেমে গেল। মেয়েটির পাশে বসা ভদ্রমহিলা জানালা দিয়ে হাত বের করলেন। হাতে একটা ম্যাগাজিন। খেয়াল করে দেখলাম আলপিন। সেটা দিয়ে উনি কাছে ডাকার ভঙ্গি করে বললেন, ‘অ্যাই ছেলে, অ্যাই।’
আমি জবাব দিলাম না। কারণ, ভদ্রমহিলাকে আমি চিনতে পারছি না। আমার পরিচিত কেউ আলপিন পড়ে না। ওনার হাতে যেহেতু আলপিন, তাহলে উনি সম্ভবত আমার পরিচিত কেউ না।
-তোমার নাম কি মদন আলী?
এবারও কোনো জবাব দিলাম না। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আমি যদি বলি, হ্যাঁ, আমার নাম মদন আলী, তাহলে ছুটে এসে আমার হাত ধরবেন।
আমি একটু হাসলাম। আমার স্টকে বিভিন্ন ধরনের হাসি আছে। এটা হলো বিভ্রান্তিমূলক হাসি। এ আশায় যেন তিনি ধরতে পারেন আমি মদন না হলেও মদন। গাড়িটিতে খুব উঠতে ইচ্ছে করছে। উঠলেই তো মেয়েটার চোখ দেখতে পাব। মদন হলে নিশ্চয় গাড়িতে উঠতে বলবে।
হাসিতে কাজ হলো। তিনি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বললেন, ‘ও মা! মদনই তো?’
-কিরে, কথা বলছিস না কেন? তুই মদন না?’
আমাকে উনি তুই করে বলছেন। মদন নিশ্চয়ই খুব কাছের লোক হবে। মেয়েরা অতি দূরের আÍীয়কে কাছের মানুষ প্রমাণ করার জন্য চট করে তুই বলে। আমি জবাব দিলাম।
-হ্যাঁ।
-আমাকে চিনতে পারছিস?
-না।
-আমি তোর ঘসেটি খালা। এখন চিনেছিস?
আমি চিনলাম না, কিন্তু হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম চিনেছি। ঘসেটি নামে আমি একজনকেই চিনি, সে সিরাজউদ্দৌলার খালা। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা, যার হাতে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।
-মদন, তুই এখানে কী করছিস?
-রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল কলছিলাম। দেখছ না কী জ্যাম।
-আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস কেন? আমি তোর খালা না? আয়, উঠে আয়?
-যাক উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি পাজেরোতে ঢুকে পড়লাম।
ছোটখাটো একটা চলন্ত বেহেশতে ঢুকে পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, বেহেশত জানি কয়টা? সাতটা, না আটটা? যাক, এটা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। গাড়িতে এয়ার কন্ডিশনার চালু আছে। শীত শীত ভাব। বেহেশতে কি এয়ার কন্ডিশনার আছে? ওটা নিশ্চয়ই সেন্ট্রাল এসি সিস্টেম। কারও যদি ঠান্ডা লাগে, তাহলে কি চাদর সাপ্লাই দেওয়া হবে?
আমার ঘসেটি খালা তাঁর মেয়ের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘মারিয়া, এই হচ্ছে মদন। খুব ভালো হাত দেখতে পারে। হাত দেখাবি?’
ভেতরে ঢুকেই ল করছি মেয়েটি একমনে আলপিন পড়ে যাচ্ছে। তার মায়ের কথা শুনে কোনো রকম উৎসাহ দেখানো দূরে থাক, আলপিন থেকে চোখ পর্যন্ত তুলল না। এটা বড় ধরনের অভদ্রতা। তবে রূপবতীদের সব অভদ্রতা মা করা যায়। এরা অভদ্র হবে, এটাই স্বাভাবিক। এরা ভদ্র হলে অস্বস্তি লাগে।
ঘসেটি খালা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘মেয়েটার যে কী হয়েছে, আলপিন ছাড়া কিছু বোঝে না। সোমবার দিন তার আলপিন পড়া চাই-ই চাই। তুই কিছু মনে করিস না।’ ঘসেটি খালা নিজের হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘আমার হাতটাই দেখে দে তো। খুব মন দিয়ে দেখবি।’
মারিয়া চোখ তুলে এক পলকের জন্য মায়ের মুখ দেখে আবার আলপিন পড়তে শুরু করল। এই এক পলকের দৃষ্টিতেই তার ভস্ম হয়ে যাওয়ার কথা। সানগ্লাসের কারণে হয়তো ভস্ম হলেন না।
আমি খালার দুই হাতের দিকে তীè দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, ‘আপনার সামনে ভয়াবহ দুর্যোগ। পারিবারিক সমস্যা। অসম বিবাহঘটিত সমস্যা। এ সমস্যা মেটার নয়। সমস্যা বাড়তে বাড়তে এক্সপ্লোশান লিমিটে চলে যাবে।’
আড়চোখে ল করছিলাম, মারিয়া ‘আমার ইয়ে সব জানে’ পড়ছে। আমার কথা শুনে আলপিনটা ভাঁজ করে রাখল। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। আমি নিশ্চিত হলাম, এই মেয়ে মানুষ না। এ হলো হুর। এদের শুধু বেহেশতেই পাওয়া যায়। চোখগুলোর সঙ্গে রূপার চোখের কিছুটা মিল আছে। একবার আমি রূপাকে বলেছিলাম, তোমার চোখগুলো আমাকে খুলে দেবে? কাচের জারের ভেতর ফরমালিন দিয়ে রেখে দেব, আর না হয় হলুদ পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে ঘুরব। রাস্তাঘাটে দেখতে ইচ্ছে করলে বের করে দেখব।
আমার চিন্তার সুতা কেটে গেল। মারিয়া বলে উঠল, ‘মা, এ মদনদা নয়।’ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে ঠিক আগের ভঙ্গিতে হাসলাম। যে হাসি দিয়ে মেয়ের মাকে বিভ্রান্ত করেছিলাম, সেই হাসিতে মারিয়াকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। মারিয়া বিভ্রান্ত হলো না। এ যুগের মেয়েদের বিভ্রান্ত করা কঠিন। মারিয়া দ্বিতীয়বার আগের চেয়েও কঠিন গলায় বলল, ‘মা, তুমি কাকে তুলেছ? এ মদনদা নয়, হতেই পারে না। এ অন্য কেউ। ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান।’ ড্রাইভার বারবার সন্দেহজনক চোখে তাকাচ্ছিল। এবার রু গলায় বলল, ‘ব্রাদার, নামুন।’ সূর্যের চেয়ে বালি গরম।
আমি হুঙ্কার দিয়ে উঠলাম, ‘চুপ, ব্যাটা ফাজিল। এক চড় দিয়ে চোয়াল ভেঙে দেব। চিনিস, তুই আমাকে চিনিস?’
বড়লোকের ড্রাইভার ও দারোয়ান এরা খুব ভীতু প্রকৃতির হয়। সামান্য ধমকাধমকিতে পিলে চমকে যায়। আমি একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, ‘আমার নাম মদন না। আমি হিমু। ভালো নাম হিমালয়। হিমালয় থেকে হিমু।’ মারিয়া একটুও ভড়কে যায়নি। স্বাভাবিক গলায়ই বলল
-ঠাট্টা করছেন?
-না, ঠাট্টা করছি না।
আমি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট বের করে এগিয়ে দিলাম। হাসিমুখে বললাম, ‘সার্টিফিকেটে লেখা আছে, দেখুন।’
মারিয়া হতভম্ব হয়ে গেল, ‘আপনি কি পকেটে সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরে বেড়ান?’ উত্তর দেওয়ার আগেই গাড়ি ব্রেক কষে থেমে গেল। গাড়ির পাশেই মোটরসাইকেলে বসে আছে একজন পুলিশ সার্জেন্ট। ড্রাইভার তাকে চোখ বড় বড় করে কী সব বলছে! পুলিশে ধরা আমার জন্য নতুন কিছু না। আগেও অনেকবার ধরেছে। পুলিশে ধরা বিষয়ে আমার বাবা উপদেশ খাতায় লিখে রেখে গেছেন:
উপদেশ নম্বর ৪২০
পুলিশ এবং আর্মি
‘পুলিশকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। তাহারাও মানব সন্তান। কিন্তু সেনাবাহিনীকে ভয় পাইয়া চলিবে। তাহারা ধরিলে ান্ত নাই। তোমার হাড্ডিগুড্ডি ভাঙিয়া ফেলিবে এবং শেষে তোমার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কাহারও রা করার উপায় নাই। অতএব, সেনাবাহিনী হইতে সাবধান থাকিবে।’
যাক, সেনাবাহিনী ধরেনি। এখন বসে আছি থানার ওসির সামনে। ওসি সাহেবের চেহারা বেশ ভালো। ক্রমাগত বেনসন অ্যান্ড হেজেস টেনে যাচ্ছেন। খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফাইলে কী জানি খুঁজছেন। আমার দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে নিলেন। আমি অস্বস্তি নিয়ে বসে আছি। তার প্যাকেট থেকে একটা বেনসন ধরিয়ে ফেললে কেমন হয়! খুব কি হতভম্ব হয়ে যাবে? ওসি সাহেব আচমকা কয়েকটা ম্যাগাজিন আমার দিকে ছুড়ে মেরে বললেন, ‘ওই কোনার বেঞ্চে গিয়ে বসে এগুলো পড়তে থাকুন। আপনার ঘটনা পরে শুনব।’
আমি ম্যাগাজিনগুলো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সব আলপিন। ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে আমি একটু হাসলাম। আমার স্টকের একটা বিশেষ হাসি। ওসি সাহেব সেটা দেখে বিভ্রান্ত হলেন না। হলে বুঝতেন হিমুরা কখনো আলপিন পড়ে না। হিমুদের আলপিন পড়তে নেই।’
প্যারডিটি আলপিনের ঈদসংখ্যায় (২০০০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে) প্রকাশিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন