সিমু নাসের
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোর বুধবারের ক্রোড়পত্র স্বপ্ন নিয়েতে ১৭ মার্চ ২০১০।
ঝিলমির সঙ্গে পাক্কা সাড়ে তিন বছরের সম্পর্কটা একেবারেই চুকেবুকে গেল অর্ণবের। রাতের বেলা দু-তিন মিনিটের জন্য অর্ণবের মুঠোফোন ব্যস্ত থাকাটা ঝিলমির কাছে অবশ্যই তুচ্ছ কোনো বিষয় নয়। অর্ণবের একটা বড় অপরাধ, অর্ণব কেন তার প্রয়োজনীয় কথা দিনের বেলা সেরে রাখে না, ঝিলমি ঘুমিয়ে পড়ার আগেই কী কথা কাহার সনে?
নিকট-বন্ধুরা অর্ণবকে বলেছে, ওরে, ঝিলমিটা ঘুমাক, তারপর নাহয় অন্যদের সঙ্গে কথা বলিস। কিন্তু সেসব কথায় ও কান দিলে তো! এমন অসাবধানি ছেলের তো ঝামেলা হবেই—ঝগড়াঝাঁটি হবে, কথাকাটাকাটি হবে। হলোও তা-ই। এমন প্রায়ই হয়, সবারই হয়। কিন্তু এবার
মাস গড়িয়ে বছর গেল, ওদের মুখ-দেখাদেখি নেই। মুঠোফোন বার্তা থেকে জিমেইল ইনবক্স—সব ধুধু মরুভূমি। একটাও স্যরি মেইল নেই, গুগল টকে নেই কোনো করাঘাত। তো এভাবেই তাদের চলছিল গত হপ্তা অব্দি।
বন্ধুমহলে হঠাত্ শোরগোল। ঘটনা কী? অর্ণব নাকি এখন সেন্ট মার্টিনে, হানিমুনে। সঙ্গে কে? বলে, ‘বউ।’ বউ তো বটেই। কিন্তু মেয়েটা কে? ফোনে মেয়েটার হাসি শুনে বন্ধুরা চিনে ফেলে, ‘এটা ঝিলমি না!’ সে বলে, ‘হ, ঝিলিমিলি ঝিলমিই তো।’ ‘কেমনে কী, অর্ণব?’ সে উত্তর দেয়, ‘সব মহান ফেসবুকের আশীর্বাদ।’ বন্ধুরা অবাক, ‘ফেসবুক মানে ওই ফেসবুক ওয়েবসাইট, নীল রঙের যে!’ খেঁকিয়ে ওঠে অর্ণব, ‘কী, ফেসবুক একটা ওয়েবসাইট? কী সাহস! মহান ফেসবুক মোটেই ওয়েবসাইট নয়। এটা হলো ওয়েবসাইটের ছদ্মবেশে থাকা একালের ডিজিটাল দূত, অবতার।’ ‘এই সেরেছে’ বলে বন্ধুরা আর্তনাদ করে তাকে চেপে ধরে, ‘ঘটনা কী?’ অর্ণব ঘটনা বলে। বন্ধুরা ঘটনা শুনে কপালে হাত তুলে ফেসবুককে জানায় নীল সালাম। সেই ঘটনা বলার আগে একটু পেছনে ফিরে যাওয়া দরকার।
উস্কখুস্ক চুল, ঢলঢলে ট্রাউজার আর টিশার্ট। একদম একটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের শুরুর দিকে এ-ই ছিল অর্ণব। সত্যি কথা বলতে কি, বন্ধুদের চোখে ওর তখন কোনো ‘স্ট্যাটাস’ই ছিল না। থাকত সব সময় একা একা, কোনো ‘ফ্রেন্ড’ নেই, কারণ ওর অবস্থা দেখে কেউ ওকে ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ও করত না। কারও সঙ্গে কোনো ‘ডিসকাশন’ নেই, কোনো ‘গ্রুপ’-এ মেশে না। ওর অভিধানে কোনো ‘লাইক’ নেই। মামার দোকানে শিঙাড়া খেতে যাবে সবাই, ও ক্যাম্পাসের বাউন্ডারি ‘ওয়াল’-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, যাবে না। কারণ সে শিঙাড়া ‘ডিজলাইক’ করে। সবাই মিলে বকা দিলে ও মিটিমিটি হাসত, কোনো ‘কমেন্ট’ করত না। বন্ধুরা বাচাল রুমির সঙ্গে ওকে ‘ট্যাগ’ করে দিল, একটু যদি ‘সোশ্যাল’ হয়। কিন্তু কিসের কী! দুদিনেই ও ‘রিমুভ ট্যাগ’ করে ফেলল। একদিন এসে জানাল, সে হতাশ। ভার্সিটি থেকে ‘লগ আউট’ করে পড়াশোনা জিনিসটাই জীবন থেকে ‘ডিঅ্যাকটিভেট’ করে দেবে। এই বলে সে উদাস হয়ে আকাশ দেখে।
ঠিক সেদিনই সেই একই ‘হায় হায়’ করে উঠল অর্ণব করিডরে আনমনা হয়ে হাঁটতে থাকা ফার্স্ট ইয়ারের ঝিলমিকে দেখে। বন্ধুরা বলল, হায় হায় করে লাভ হবে না, নিজেকে ‘আপডেট’ করো। সেদিন থেকেই ‘বদলে যাও’ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাটাসাট নিজেকে ‘আপডেট’ করতে শুরু করল অর্ণব। ফেসবুকের ভার্সিটি ‘নেটওয়ার্ক’ থেকে খুঁজে বের করে ঝিলমিকে ‘অ্যাড’ করণ অর্নব। এরপর ঝিলমির প্রতিটা স্ট্যাটাসে পড়তে থাকে অর্ণবের ‘লাইক’ ক্লিক। অর্ণবেরও স্ট্যাটাসের বহর দেখে কে—স্ট্যাটাসহীনতায় কে বাঁচিতে চায়, হায়! অর্ণবও চায় না। তার স্ট্যাটাসের ‘উইট’ দেখে একদিন ডাক আসে এক নামকরা বিজ্ঞাপনী সংস্থা থেকে, পদবি: কপিরাইটার। পার্টটাইম চাকরি। এ খবর স্ট্যাটাসে দেওয়ার পর প্রথম যে ‘লাইক’ করল, সে ঝিলমি। অর্ণবকে আর পায় কে!
এদিকে ঝিলমির আবার ছিল টুকটাক ফটোগ্রাফির শখ। কোথাও বেড়াতে গেলে ক্যামেরা ছিল তার নিত্যসঙ্গী—কত যে ক্লিক, ক্লিক। তারপর সেসব থেকে বাছাই করে কিছু ছবি সে ‘আপ’ করত তার ‘অ্যালবামে’। একদিন ঝিলমির সেসব অ্যালবামেরই একটা ছবি বিজ্ঞাপনে ব্যবহারের প্রস্তাব দিল অর্ণব। ঝিলমি রাজি। তারপর অনেক অনেক কথা, অনেক অনেক দেখা, ছবি ছাড়াও আরও কত কী যে আদান-প্রদান!
আচ্ছা, এবার বলো তো, এই ফেসবুক যদি না থাকত (কী অলক্ষুনে কথা!), তাহলে কী হতো? সক্রেটিস বলে গিয়েছিলেন, নো দাইসেলফ—নিজেকে জানো। আর ফেসবুক এক ধাপ এগিয়ে বলে, শুধু নিজেকে কেন, সঙ্গে অন্যকেও জানো, জানাও। বাইরে থেকে আর কতটুকু মানুষকে জানা যায়। মানুষ জানা যায় কর্মে। আর কর্তার ক্রিয়াই কর্ম। এখানে কর্তা কে? তুমি। তুমি কী করো? ছবি আঁকো, ছবি তোলো, গান গাও, কবিতা লেখো, গল্প লেখো, সেবামূলক কাজ করো, হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে ছবি বানাও, তথ্যচিত্র বানাও, ডাকটিকিট সংগ্রহ করো—যা-ই করো না কেন, ছড়িয়ে দাও না কেন ফেসবুকে! নিজেকে প্রকাশ করো।
আচ্ছা, তুমি যদি ফটোগ্রাফার হও বা চিত্রকলার ছাত্র হও, তাহলে চিন্তা করো তো, ঢাকায় গ্যালারি ভাড়া নিয়ে সাত দিনের একটা প্রদর্শনী করতে হ্যাপা কতটুকু? এই ভাড়ার টাকা দাও রে, ব্রশিওর ছাপাও রে। তুমি তো বাবার হোটেলেই খাও-দাও-পরো। তুমি এসবের টাকা পাবে কোথায়? তার চেয়ে অনেক ভালো না একটা ফেসবুক প্রদর্শনীই করে ফেলা? বাজি ধরে বলা যায়, ঢাকার একটা গ্যালারিতে যত জন এসে তোমার ছবি দেখবে, তার চেয়ে ঢের বেশি লোক ফেসবুকে তোমার প্রদর্শনী দেখবে। ঢাকা শহরে এ মুহূর্তে ফেসবুক-সদস্যসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। আর প্রবাসী বাংলাদেশি তো রয়েছেই। গ্যালারিতে প্রদর্শনী করলে কি তারা বিদেশ থেকে এসে দেখতে পারত? আর এমন তরতাজা মন্তব্যই বা তুমি পেতে কোথায়? নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো অন্যের অনুপ্রেরণা আর উৎসাহেরও প্রয়োজন আছে। ফেসবুক এসবের খনি। এটাকে নেশা না বানিয়ে, শুধু শুধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট না করে জিনিসটাকে কাজে লাগাও। ঢোলটা তোমার নিজেরই হাতে, জোরসে বাজাতে থাকো, ফেসবুকে তোমাকেও খুঁজে পাবে তোমার মতের লোকেরা, যেখানে বন্ধুবান্ধব সবাই বিরাজ করে .JPEG ফরম্যাটে।
একটা কৌতুক আছে না, স্ত্রীর জন্মদিন মনে রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় একবার তার জন্মদিন ভুলে যাওয়া। তবে ফেসবুকের কল্যাণে বন্ধুবান্ধবের জন্মদিন মনে রাখা এখন নস্যি। তা ছাড়া ফেসবুকে রয়েছে...আচ্ছা, দুঃখিত, ক্ষমা করবেন। প্রতিবেদক সম্ভবত লেখার এই শেষ পর্যায়ে এসে ভুল করে ফেসবুকের বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের বর্ণনা দেওয়া শুরু করেছে। সে পাগল, না মাথা খারাপ, ফেসবুকে আছে প্রায় পাঁচ লাখ মজার মজার এবং দরকারি অ্যাপ্লিকেশন। কয়টার বর্ণনা দেবে সে? তোমাদের যার যার অনেক জানার শখ, তারা নিজ দায়িত্বে গিয়ে সেসব খুঁজতে থাকো আর খুঁজে পেয়ে জেনে জ্ঞানী হও গে, যাও। তবে একটা বিষয় কি, ফেসবুকে কিন্তু ছদ্মবেশীর (ফেক আইডি)-র অভাব নেই। তাদের প্রতারণার ফাঁদ থেকে সাবধান! একদমই চেনো না, কিংবা চিনলেও ধোঁয়াশা চরিত্রের মনে হয়, তাদের ‘অ্যাড’ না করাই ভালো। আর করলেও ‘লিমিটেড প্রোফাইলে’ যোগ কর। তারপর ‘সেটিংস’ থেকে তারা যাতে তোমার সকল ছবি, তথ্য না পায়, সে ব্যবস্থা করে দাও। তুমি তা করতে থাক, সেই ফাঁকে বরং ঝিলমি আর অর্ণবের বিয়ের কাহিনিটুকু শেষ করে এই ফেসবুক লেখার নটেগাছটি মুড়োনো হোক।
...তো ওই ঝগড়ার পর টানা দেড় বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না ঝিলমি আর অর্ণবের। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস থেকে ‘ইন অ্যা রিলেশনশিপ উইথ অমুক’ মুছে ফেলে ঝগড়ার পরপরই ‘সিঙ্গেল’ হয়ে গিয়েছিল তারা। কিন্তু ঠিকই প্রতিদিন নিয়ম করে একে অপরের ফেসবুক প্রোফাইল দেখত দুজন। কে কী করছে খোঁজখবর রাখত। একদিন ঝিলমি দুষ্টুমি করে তার ‘রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে’ লিখে দিল ‘এনগেজড’। সেটা দেখে তো অর্ণবের মাথা খারাপ। সঙ্গে সঙ্গে ফোন, ‘তুমি এনগেজড মানে!’ ঝিলমির উত্তর, ‘এনগেজড মানে এনগেজড, তাতে তোমার সমস্যা কী? আমি এনগেজড হতে পারি না?’ অসহায় আত্মসমর্পণ অর্ণবের, ‘ফাজলামি করবা না, আমি স্যরি, কালকেই আব্বা-আম্মাকে নিয়ে তোমার বাসায় আসছি।’...পরদিনই বিয়ে হয়ে যায় ঝিলমি-অর্ণবের। তারপর রাতের বাসে সেন্ট মার্টিনে।
সবাই বলে, যুগটা নাকি প্রযুক্তির। তোমাদের মোবাইল আছে, স্যাটেলাইট ফোন আছে, অমুক আছে, তমুক আছে। কোথায় তোমাদের সেসব প্রযুক্তি? তারা কি পেরেছে এখনকার বিখ্যাত আলোকচিত্রী ঝিলমি আর প্রখ্যাত এক বিজ্ঞাপনী সংস্থার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর অর্ণব হাসানের মান ভাঙাতে? পারেনি। সবাই ফেলটুস মেরেছে। তাহলে পেরেছে কে? পেরেছে মহান ফেসবুক।
তাই তো বলি, এগিয়ে যাও। স্বপ্ন নিয়ে, স্বপ্ন গড়তে কাজে লাগাও ফেসবুককে। দেখবে, অফুরন্ত আনন্দের ঠিকানা পেয়ে যাবে, কিন্তু সারা দিন যদি অন্য কাজ ফেলে ওখানেই পড়ে থাকো, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যত্ ঝরঝরে হয়ে যাবে। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন