সিমু নাসের
আজ থেকে দশ বছরেরও বেশি আগে ১৯৯৯ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন কোন এক শীতের বিষন্ন বিকেলে হলের টেবিলে বসে আমি এই গল্পটা শুরু করেছিলাম। ফ্যান্টাসি সায়েন্স ফিকশান। শুরুটা লেখার পরই ড্রাফটটা হারিয়ে যায়। কয়েকদিন আগে পুরোনো ক্লাস খাতাটায় লেখাটা খুজে পেলাম। আবার যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য এখানে জমা রাখলাম। একদিন না একদিন গল্পটা আমি শেষ করবই।
নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার ইত্তেফাক-এর ব্যক্তিগত কলামে একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। চারকোনা বক্সের ভেতর ছোট ছোট হরফে লেখা বিজ্ঞাপনটা বেশ অদ্ভুত। ‘অপূর্ব সুযোগ! অপূর্ব সুযোগ!! তুমি কি আউটার স্পেসে বসতি বিশ্বাস করো? তুমি কি স্থায়ীভাবে সেখানে মাইগ্রেশন করতে চাও? আইএলটিএসের প্রয়োজন নাই। আজই কাওসার আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করো।’ এরপর ধানমন্ডির একটা বাসার ঠিকানা দিয়ে নিচে বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লেখা ‘১৮ বছরের বেশি বয়সীদের যোগাযোগ কাম্য নহে।’
এত এত বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ব্যতিক্রমধর্মী এ বিজ্ঞাপনটা চোখেই পড়ে না অনেকের, তবে যাদের পত্রিকার প্রথম থেকে শুরু করে শেষ লাইন পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যাস, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ফালতু বিজ্ঞাপন মনে করে কেউ আর ওটাকে নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না, ফলে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতেও কেউ আসে না, অন্তত গতকাল পর্যন্ত আসেনি। শুধু আজকের দিনটা একটু অন্য রকম।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিসরুমে বসে মাছি মারার চেষ্টা করছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। কিন্তু রুমটা এসি হওয়ায় মাছি মারাতেও তিনি খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না। রুমে মাছিই নেই। কিক শব্দ করে দরজা খোলার আওয়াজ হতেই তাকালেন সেদিকে। পার্সোনাল সেক্রেটারি রুমানার গোলগাল ফর্সা মুখটায় উত্তেজনার ছায়া, ‘স্যার, সাদা স্কুল ড্রেস পরা স্কুলের একটা বাচ্চা ছেলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’ হাসি ফুটে উঠল কাওসার আহমেদ চৌধুরীর মুখে। এদের সঙ্গে দেখা করার জন্যই তো তিনি অপো করছেন। ছয় মাস হলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন। একজন না একজন দেখা করতে আসবেই, এটা তিনি জানতেন। ‘ভেতরে পাঠিয়ে দাও ওকে’ অনুমতি দিলেন তিনি। ‘ঠিক আছে, স্যার’ বলে দরজা বন্ধ না করেই উল্টো দিকে হাঁটা ধরল রুমানা।
চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন কাউসার আহমেদ চৌধুরী। প্রথমে দরজাটা বন্ধ করলেন।
কয়েক মুহূর্ত পরই দরজায় দেখা গেল সাদা ড্রেসকে। ‘মে আই কাম ইন’ প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উঠে বলে উঠল ছেলেটি। উচ্চারণ ভঙ্গি বেশ স্পষ্ট। সরাসরি তার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন কাওসার আহমেদ। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘ইয়েস।’ দৃঢ় ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটি। যথেষ্ট স্মার্ট। কাওসার আহমেদ অনুমান করলেন ছেলেটির বয়স ১৪ কি ১৫, কাঁধে স্কুলব্যাগ আর ড্রেস স্যা দেয় সরাসরি স্কুল থেকেই এখানে এসেছে সে। চেহারাটার মধ্যে বাচ্চা বয়সের সারল্যের যেন একটু কমতি আছে, চোখ দুটো বড্ড চঞ্চল, পুরো রুমটার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে, অগোছালো চুল চেহারায় বুদ্ধিমত্তার ছাপকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
বসার অনুমতি পেয়ে বসল ছেলেটি। কী যেন একটু ভাবল মনে মনে। তারপর কাওসার আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে একটুও নার্ভাস না সে। ‘আমার নাম নাবিল হাসান, বাসায় এবং বন্ধুরা রাজু নামে ডাকে। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে কাস নাইনে পড়ি। পড়াশোনা করতে একদম ভালো লাগে না। মনে হয় সারা দিন বসে বসে যদি গল্পের বই পড়তে পারতাম! বিশেষ করে সায়েন্স ফিকশন আমার সবচেয়ে প্রিয়। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, মানুষের থেকেও বুদ্ধিমান প্রাণী ইউনিভার্সে ছড়িয়ে আছে। আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতি চাই, তাই বিজ্ঞাপনটা দেখে স্কুল পালিয়ে এখানে চলে এলাম।’ টেবিলের কোনাটা ধরে একটু ঝুঁকে সন্দেহের সুরে সে যোগ করল, ‘আচ্ছা, আপনিই তো কাওসার আহমেদ, নাকি?’
কৌতুক ফুটে উঠল কাওসার আহমেদের চোখে। বললেন, ‘সম্ভবত আমিই। অন্য কেউ হলে তোমার কথা এত মনোযোগ দিয়ে শুনত বলে মনে হয় না।’ কৃত্রিম লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করল ছেলেটি, ‘দুঃখিত, আমি সম্ভবত একটু বেশি কথা বলছি, এটা আমার অভ্যাস। কিছু মনে করবেন না। তা যা-ই হোক আপনার বিজ্ঞাপনটা কি সত্যি? কোনো প্রতারণা নয় তো? দেখুন, আমি কিন্তু খুব চালাক। ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমাকে উটের জকি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো কিন্তু খুব একটা সহজ হবে না আপনার জন্য। সে রকম কোনো চিন্তা থাকলে এখনই বাদ দিন।’ একটু দম নিল ছেলেটি। তারপর বলল, ‘আ...আমি এই পড়াশোনা, পরীক্ষা এগুলোর ওপর খুব খুব বিরক্ত। আপনি কি সত্যি সত্যিই এ রকম কোনো গ্রহে পাঠাতে পারবেন, যেখানে পড়াশোনার বালাই নেই।’
ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড খুশি হয়ে উঠলেও... (অসমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন